তীব্র তাপপ্রবাহে জনজীবনের পাশাপাশি বিরূপ প্রভাব পড়ছে ফসলে। বিশেষ করে বোরো ধানে, যা দেশের খাদ্যশস্যের প্রধান চাহিদা মেটায়। আশঙ্কা দেখা দিয়েছে হিটশকের। এই সময়ে বোরো ধানের নিরাপত্তায় ক্ষেতে পর্যাপ্ত পানি ধরে রাখাসহ প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
তাপপ্রবাহে ধানের পরিচর্যা প্রসঙ্গ নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) উদ্ভিদ শরীরতত্ত্ব বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. সাজ্জাদুর রহমান।
তীব্র তাপপ্রবাহে ধানের কী ধরনের সমস্যা হয়?
সাজ্জাদুর রহমান: দেশের হাওরাঞ্চল ছাড়া অধিকাংশ এলাকায় ধানগুলো ফ্লাওয়ারিং স্টেজে রয়েছে। অর্থাৎ, ফুল ফুটছে। এ সময়টা খুব নাজুক। চলমান তাপমাত্রায় হিটশকের একটি ঝুঁকি রয়েছে। ২০২১ সালে এমন পরিস্থিতিতে অনেক এলাকায় ধান নষ্ট হয়ে চিটা হয়েছিল।
হিটশক কী? ২০২১ সালে কী হয়েছিল?
সাজ্জাদুর রহমান: মার্চের শেষে বা এপ্রিলের শুরুতে কালবৈশাখী ঝড় হয়। ওই বছর (২০২১ সালে) এখন যেমন গরম, তেমন গরম ছিল। কিছু এলাকায় ঝড় হলেও অনেক এলাকায় গরম বাতাস বয়ে যায়। তখন সারাদেশে বোরো ধানের ফুল ফোটার সময় চলছিল। ওই সময় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যা ধানের জন্য ক্রিটিক্যাল টেম্পারেচার ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশ ওপরে। তখন বোরো ধানের ফোটা ফুলগুলো শুকিয়ে যায়। মানুষ যেমন অধিক গরমে হিটস্ট্রোক করে, তেমন ধানের ক্ষেত্রে এ পরিস্থিতিকে আমরা হিটশক বা হিটস্ট্রোক বলছি।
অতিরিক্ত তাপমাত্রা বাড়া অথবা কমা দুই কারণে হিটশক বা হিট ইনজুরি হয়। ফ্লাওয়ারিংয়ের সময় তাপমাত্রা এর নিচে থাকতে হয়। যেটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বেশি থাকছে।
এবছর কি তেমন পরিস্থিতির আশঙ্কা রয়েছে?
সাজ্জাদুর রহমান: হ্যাঁ। এখন ধানের ফ্লাওয়ারিং চলছে। তাপমাত্রা ধানের জন্য সহনীয় মাত্রার বেশি। এখন যদি দু-তিন ঘণ্টা ৮০-৯০ কিলোমিটার বেগে গরম বাতাস বয়ে যায় তবে হিটশক হবে।
গাছের স্বাভাবিক অবস্থা কীভাবে ব্যাহত হয়?
সাজ্জাদুর রহমান: ধানগাছ হিট থেকে বাঁচার জন্য নিজস্ব কুলিং সিস্টেম তৈরি করে। মাঠে পানি থাকলে সেটা ব্যবহার করে নিজের তাপমাত্রা তিন-চার ডিগ্রি কমিয়ে রাখার চেষ্টা করে। আবার হিট থাকলে প্রচুর পানি গাছ থেকে বেরিয়ে যায়। কিন্তু তাপমাত্রা এখনকার মতো অস্বাভাবিক হলে সবকিছুতে সমস্যা হয়। একদম শুকিয়ে যায়।
আপনারা প্রায়ই মাঠ পরিদর্শনে যাচ্ছেন, পরিস্থিতি কেমন দেখছেন?
সাজ্জাদুর রহমান: পরাগায়নের সময়কাল ঠিকমতো হচ্ছে না। কারণ সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে স্বাভাবিক পরাগায়ন হয়, তখন তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রির ওপর চলে যাচ্ছে। যে কারণে পরাগায়নের সময় এগিয়ে এসেছে। এছাড়া তাপমাত্রার কারণে আরও একটা সমস্যা হচ্ছে, ধানের দানা গঠন ঠিকমতো হচ্ছে না। কারণ ধানগাছ দিনে খাদ্য তৈরি করে, যা রাতে ভেঙে ধানের দানা তৈরি করে। এটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। রাতের তাপমাত্রাও বেশি। যে কারণে ধানের পুষ্টতা (গ্রেইন ফিলিং) কম হচ্ছে। অর্থাৎ, ধানের খোসার ভেতরের কার্বোহাইড্রেড বীজ ছোট হচ্ছে। তাতে সামগ্রিক উৎপাদনে প্রভাব হবে। অর্থাৎ, কমে যাবে।
ধানের সহনীয় তাপমাত্রা কত?
সাজ্জাদুর রহমান: অতিরিক্ত তাপমাত্রা বাড়া অথবা কমা দুই কারণে হিটশক বা হিট ইনজুরি হয়। ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসকে হিটশকের মাত্রা ধরা হয়। যেখানে এখন দেশের তাপমাত্রা ক্রমাগত বাড়ছে। ফ্লাওয়ারিংয়ের সময় তাপমাত্রা এর নিচে থাকতে হয়। যেটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বেশি থাকছে।
বোরো মৌসুম শীতে নভেম্বর (কার্তিক-অগ্রহায়ণ) মাসে শুরু হলেও শেষটা হয় চরম গরম এপ্রিল-মে (বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ) মাসে। গত কয়েক বছর এসময় তীব্র তাপপ্রবাহ হচ্ছে। ফুল ফোটার সময় তীব্র তাপপ্রবাহ এ-দুই ঘণ্টা বিরাজ করলে মাত্রাতিরিক্ত চিটা হয়ে যায় ধান। আবার তাপপ্রবাহের মধ্যে কালবৈশাখীও থাকে। যখনই তাপপ্রবাহ হয় এবং সে সময় বৃষ্টি থাকে না তখনই ধানের জন্য তা হিটশক। অর্থাৎ, বৃষ্টিহীন তাপপ্রবাহের সময় ধানের ফুল এলে তা শুকিয়ে যায়।
দেশে ধানের ক্ষেত্রে এমন হিটশক কতদিন ধরে দেখছেন?
সাজ্জাদুর রহমান: ২০১২ সাল থেকে আমরা নিয়মিত হিটশকের তথ্য রেখেছি। ২০০৭ সালে একবার হিটশক হয়। এছাড়া কিছু এলাকায় কয়েক বছর ছোট পরিসরে হিটশক হয়েছে। এর আগে হিটশক হয়েছে যশোর সদর, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, গাজীপুরের কালিয়াকৈর এবং ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জে। তবে কখনো তা গ্রামের এক-দুটি মাঠে বা কোনো একটি এলাকার ক্ষেতে হয়েছে। বড় হিটশক ২০২১ সালে প্রথম হয়।
তাপপ্রবাহ থেকে ধান রক্ষার জন্য জমিতে পানি ধরে রাখার বিকল্প কোনো উপায় নেই। তাপমাত্রা বেশি থাকলেও পানি থাকলে তা কুলিং সিস্টেম হিসেবে কাজ করবে। ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে যদি তাপমাত্রা রাখা যায়, তাহলে এ সমস্যা হবে না।
এখন কৃষকের করণীয় কী?
সাজ্জাদুর রহমান: এ তাপপ্রবাহে কৃষকদের সতর্কবার্তা দিয়েছে ব্রি। তীব্র তাপপ্রবাহে হিটশকের ক্ষতি থেকে ধান রক্ষার উপায় হচ্ছে বোরো ধানের জমিতে পর্যাপ্ত পানি ধরে রাখতে হবে এবং ধানের শীষে দানা শক্ত না হওয়া পর্যন্ত জমিতে অবশ্যই দু-তিন ইঞ্চি পানি রাখতে হবে। এছাড়া কিছু রাসায়নিক সারের পরিমিত ব্যবহার এ প্রতিকূল অবস্থা থেকে ধানগাছকে রক্ষা করতে পারে।
এছাড়া কৃষক আর কী করতে পারেন?
সাজ্জাদুর রহমান: তাপপ্রবাহ থেকে ধান রক্ষার জন্য জমিতে পানি ধরে রাখার বিকল্প কোনো উপায় নেই। এসময় জমিতে যেন পানির ঘাটতি না হয়। যাতে তাপমাত্রা বেশি থাকলেও পানি থাকলে তা কুলিং সিস্টেম হিসেবে কাজ করবে। ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে যদি তাপমাত্রা রাখা যায়, তাহলে এ সমস্যা হবে না।
অন্য রোগও হচ্ছে তাপমাত্রার কারণে, সেক্ষেত্রে কৃষকদের করণীয় কী?
সাজ্জাদুর রহমান: এ অবস্থায় শীষ ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ হতে পারে। তাই রোগের লক্ষণ প্রকাশের আগেই প্রিভেনটিভ হিসেবে বিকেলে ট্রুপার ৮ গ্রাম ১০ লিটার পানিতে অথবা নেটিভো ৬ গ্রাম ১০ লিটার পানিসহ প্রতি পাঁচ শতাংশ জামিতে পাঁচদিন ব্যবধানে দুবার স্প্রে করতে হবে।
অন্য রোগও হচ্ছে তাপমাত্রার কারণে, সেক্ষেত্রে কৃষকদের করণীয় কী?
সাজ্জাদুর রহমান: এ অবস্থায় শীষ ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ হতে পারে। তাই রোগের লক্ষণ প্রকাশের আগেই প্রিভেনটিভ হিসেবে বিকেলে ট্রুপার ৮ গ্রাম ১০ লিটার পানিতে অথবা নেটিভো ৬ গ্রাম ১০ লিটার পানিসহ প্রতি পাঁচ শতাংশ জামিতে পাঁচদিন ব্যবধানে দুবার স্প্রে করতে হবে।