রহিমা বেগমেকে উদ্ধারের সময়ই তার কাছে একটি প্যাকেট দেখে পুলিশের সন্দেহ হয়, তিনি অপহরণ নয়, অন্য কোনো ঘটনা রয়েছে। সেই সন্দেহ থেকেই অনুসন্ধানে প্রমাণ মিলেছে তিনি অপহরণ হননি, জমি জমা সংক্রান্ত বিষয়ে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে ছিলেন আত্মগোপনে। করেছেন অপহরণ নাটক। অপহরণ ঘটনা তদন্তে এই তথ্য পেয়েছে পিবিআই।
আজ সোমবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে খুলনা পিবিআই কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসব জানিয়েছেন খুলনা পিবিআই এর পুলিশ সুপার সৈয়দ মুশফিক রহমান।
রহিমা বেগম, তার মেয়ে মরিয়ম মান্নান এবং আরেক মেয়ে ও মামলার বাদী আদুরি আক্তার—এই ৩ জনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে আদালতে সুপারিশ করেছে পিবিআই। একই সঙ্গে এ মামলায় জেল খাটা ৫ আসামিকে অব্যাহতির সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। আজ সোমবার সকালে মহানগর হাকিম আদালতে এ মামলার প্রতিবেদন দাখিল করে পিবিআই।
সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার বলেন, ‘তদন্তে রহিমা বেগমকে অপহরণের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বরং জমি সংক্রান্ত বিরোধে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে মরিয়ম মান্নানের নেতৃত্বে অপহরণের নাটক সাজানোর প্রমাণ মিলেছে। মূলত রহিমা বেগম অপহরণ হননি, তিনি স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে গিয়েছিলেন। ২৮ দিন আত্মগোপনে ছিলেন। এই ২৮ দিন তিনি বিভিন্ন স্থান পরিবর্তন করেছেন। ২৭ অক্টোবর দিবাগত রাতে তিনি মহেশ্বরপাশার বাসা থেকে আত্মগোপন করার পরে ঢাকায় চলে যান। সেখানে কিছুদিন অবস্থান করার পর একটি ব্যাগে কিছু কাপড় ও ওষুধ দিয়ে মরিয়ম মান্নান তাকে বান্দরবান পাঠিয়ে দেন। সেখানে কিছুদিন অবস্থান করার পর তিনি চলে যান ফরিদপুর জেলা বোয়ালমারী সৈয়দ গ্রামের জনৈক আবদুল কুদ্দুসের বাড়িতে। সংবাদ পেয়ে ওই বাড়ি থেকে রহিমা বেগমকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করি।’
পুলিশ সুপার বলেন, রহিমা বেগমকে উদ্ধারের পর তিনি কোনো কথাই বলছিলেন না। অনেক চেষ্টার পর কথা বলানো সম্ভব হলে জমিজমা সংক্রান্ত বিষয়ে প্রতিবেশীদের সঙ্গে আছে নাম উল্লেখ করে তারা অপহরণ করেছে বলে বিবৃতি দেন। পরবর্তীতে তাকে আদালতে ২২ ধারায় জবানবন্দির জন্য পাঠানো হলে তিনি একই রকমের মিথ্যা বক্তব্য দেন। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ঘটনাস্থল মহেশ্বরপাশায় পাওয়া যায়। সুতরাং তদন্ত শেষে এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মতামতে জানা যায়, শুধুমাত্র জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে প্রতিবেশীদের ফাঁসাতে মরিয়ম মান্নানের নেতৃত্বে এই অপহরণ নাটক সাজানো হয়।
বিষয়টি নিয়ে ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’ সৃষ্টি করেছিলেন মরিয়ম মান্নান জানিয়ে সৈয়দ মুশফিক রহমান বলেন, ‘ময়মনসিংহের ফুলপুর ৩০ থেকে ৩২ বছর বয়সী একটি নারীর অর্ধগলিত লাশকে তিনি নিজের মা বলে চালিয়ে দেওয়ার নাটক করেছিলেন। নাটকটির পেছনের কারণ ছিল যদি তাকে (নারীর লাশ) তার মা বলে চালিয়ে দেওয়া যেত, তাহলে প্রতিবেশীদের চিরতরে ফাঁসানো যেত এবং নিঃশেষ করা যেত। কিন্তু তিনি চিন্তা করতে পারেননি যে পুলিশ খুঁজে খুঁজে তার মাকে বের করে ফেলবে। সুতরাং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১৭ ধারা অনুযায়ী রহিমা বেগম, তার মেয়ে মরিয়ম মান্নান এবং আরেক মেয়ে ও মামলার বাদী আদুরি আক্তার এই ৩ জনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে বিজ্ঞ আদালতে সুপারিশ করেছি।’
পুলিশ সুপার বলেন, এই নাটকের মাস্টার মাইন্ড মরিয়ম মান্নান। সারা দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন মরিয়ম মান্নান, মাকে খুঁজে পাওয়ার জন্য। সে কারণে একটু বেশি সময় নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করেছি। যাতে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করতে পারি এবং সবাইকে একটা বার্তা দিতে পারি পরবর্তীতে এই ধরনের ঘটনা, এ ধরনের নাটক করতে কেউ যেন সাহস না পায়।
গ্রেপ্তার পুলিশ সদস্যদের বিষয়ে পুলিশ সুপার বলেন, ‘ইতিপূর্বে অপহরণ মামলায় যে ৫ জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল তারা এ ঘটনায় নির্দোষ। তদন্ত প্রতিবেদনে তাদের অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়েছে ।’
পুলিশ সুপার বলেন, সকালে মামলার বাদী আদুরী আক্তারকে প্রতিবেদনের বিষয়ে পড়ে শোনানো হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে যে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে বিষয়টি জানানো হয়েছে।
পুলিশ জানায়, গত ২৭ আগস্ট রাতে খুলনা নগরীর মহেশ্বরপাশা এলাকার বাড়ি থেকে রহিমা বেগম রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন। তাকে অপহরণের অভিযোগ তুলে পরদিন মেয়ে আদুরি আক্তার দৌলতপুর থানায় মামলা করেন। ২৪ সেপ্টেম্বর খুলনার দৌলতপুর থানা-পুলিশ ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারি উপজেলার সৈয়দপুর গ্রামের আবদুল কুদ্দুসের বাড়ি থেকে স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে থাকা রহিমা বেগমকে উদ্ধার করে। উদ্ধারে সময় তার কাছে একটি প্যাকেট ছিল। এই প্যাকেটটি কোথা থেকে পেয়েছেন জানতে চাইলে পুলিশকে জানায় মরিয়ম তাকে দিয়েছে। এর পর বিভিন্নভাবে তদন্ত করে প্রমাণ মেলে অপহরণের ঘটনা সাজানো। এ ছাড়া বাড়ি থেকে যেতে মরিয়ম তার মাকে বিকাশে ১ হাজার টাকাও দিয়েছিল।