বৃহস্পতিবার, ২০২৫ মে ০১, ১৮ বৈশাখ ১৪৩২
#
জাতীয় জাতীয়

দুঃখী দেশের তালিকা, নাকি গোপন এজেন্ডা!

নিজস্ব প্রতিবেদক | টুয়েন্টিফোর টিভি
প্রকাশিত : বৃহস্পতিবার, ২০২২ জুলাই ১৪, ০১:০৯ অপরাহ্ন
#
প্রতীকী ছবি।

নতুন এক বৈশ্বিক জরিপে বিশ্বের সবচেয়ে দুঃখী দেশের তালিকায় বাংলাদেশ সপ্তম স্থানে উঠে এসেছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জরিপ সংস্থা গ্যালাপ বিশ্বের ১২২টি দেশের এক লাখের বেশি মানুষের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে এই ফল প্রকাশ করেছে। ‘গ্যালাপ ২০২২ গ্লোবাল ইমোশনস রিপোর্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে মার্কিন এ সংস্থা বলেছে, সমীক্ষায় ১০০ স্কোরের মধ্যে বাংলাদেশ ৪৫ পেয়ে সপ্তম দুঃখী দেশ নির্বাচিত হয়েছে।

অন্যদিকে ৫৯ স্কোর নিয়ে শীর্ষ দুঃখী দেশ হয়েছে নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হওয়া তালেবান-শাসিত আফগানিস্তান।

অথচ চলতি বছরের মার্চেই জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্টে দেখা গিয়েছিল, বিশ্বের সুখী দেশের তালিকায় সাত ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। ১৪৬টি দেশের তালিকায় এ বছর ৯৪ নম্বরে এসেছে বাংলাদেশ। আগের বছর ১৪৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১০১। সুখী ও দুঃখী এই দুটি জরিপ পরস্পরবিরোধী।

একটিতে মনে হয় দেশ সুখের দিক থেকে এগিয়েছে, আরেকটিতে মনে হয় পিছিয়েছে। এ দুই সংস্থার জরিপের সুখের পরিমাপক দুই ধরনের হওয়ায় অবস্থাগত পার্থক্য তৈরি হয়েছে। বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, উন্নত দেশগুলোর বিভিন্ন রকম উদ্দেশ্য থাকে- প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য। যেটাকে হিডেন এজেন্ডা বলা যেতে পারে। তারা তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য টাকা দিয়ে বিভিন্ন সংস্থা দিয়ে এসব জরিপ চালায়। বিশেষ করে তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে এসব জরিপ চালায়।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রুবায়েত ফেরদৌস বলেন, উন্নত দেশগুলোর বিভিন্ন রকম উদ্দেশ্য থাকে। তারা সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য আমাদের মতো দেশগুলোর ওপর নানা ধরনের এক্সপেরিমেন্ট চালায়। কখনো কখনো জরিপের ফলাফল দেয়, আবার দেয় না। কোনো জরিপে আমরা এক নম্বরে, আবার কোনো জরিপে আমার ২০০ নম্বরে। এগুলোর আসলে কোনো ভ্যালিডিটি নেই। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের মানুষের কাছে এ ধরনের জরিপের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বন্ধ করার পর বাংলাদেশ পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ করেছে। এটি প্রমাণ করে বাংলাদেশের সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ আমরা দেখেছি পদ্মা সেতু নিয়ে কত ষড়যন্ত্র হয়েছে। একটা গোষ্ঠী তাদের স্বার্থের জন্য এটি বন্ধ করার জন্য কত কিছুই না করেছে। করোনাভাইরাসের পর বিশ্বব্যাপী সামাজিক-অর্থনৈতিক-মানসিকসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।

বিশেষ করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। তার ওপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যেন ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’। যুদ্ধের ফলে খাদ্য-জ্বালানি থেকে শুরু করে দৈনন্দিন প্রতিটি জিনিসের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো যেখানে নাকানিচোবানি খাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশ দিব্যি এগিয়ে যাচ্ছে। এ উন্নয়নের ধারা ব্যাহত করে তাদের রাজনৈতিক জায়গা পাকাপোক্ত করতে চাই। এ জন্য টাকা দিয়ে তারা বিভিন্ন সংস্থা থেকে বিভিন্ন জরিপ প্রকাশ করে।

অধ্যাপক রুবায়েত বলেন, অনেক সময় এ জরিপগুলো রাজনৈতিক জায়গা নির্মাণের জন্য করা হয়। এ ক্ষেত্রে কখনো কখনো অন্যের হয়ে কাজ করে। টাকার বিনিময়ে যেকোনো জায়গা থেকে যেকোনো জরিপ করা সম্ভব। এটাকে (গ্যালাপ ২০২২ গ্লোবাল ইমোশনস রিপোর্ট) আমার বিশ্বাসযোগ্য কোনো জরিপ বলে মনে হয়নি। এগুলো কারা করে? স্যাম্পল সাইজ কী? ম্যাথডলজি কি? কাদের দিয়ে করাচ্ছে? কীভাবে এটাকে স্কোর করল? তাদের কাছে সুখের ডেফিনেশন কী? এগুলোর স্পষ্ট ধারণা তারা দেয় না। মূলত এর ভেতরে একটা দূরভিসন্ধি থাকে এবং একটি হিডেন (গোপন উদ্দেশ্য) এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা থাকে। এ রিপোর্ট তারই একটি প্রকাশ মাত্র।

একটু পেছনে ফিরলেই দেখা যাবে, বাংলাদেশ ২০২১ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) চূড়ান্ত সুপারিশ পেয়েছে। ফলে ২০২৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ঘোষিত হবে।

উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে জাতিসংঘের তিনটি শর্ত ছিল- মাথাপিছু আয় কমপক্ষে ১২৩০ মার্কিন ডলারে রাখা, মানবসম্পদ সূচকে ৬৬ পয়েন্ট ও অর্থনীতির ভঙ্গুরতা সূচকে ৩২ বা নিচে আনা। ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশ তিনটি শর্তই পূরণ করে এসেছে। ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ১৮২৭ ডলার, যা বর্তমানে ২ হাজার ৮২৪ ডলার। মানবউন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের পয়েন্ট ৭৫.৩ এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে ২৫.২।

শুধু তাই নয়, প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৩তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। করোনা মহামারির মধ্যেও ২০২০-২০২১ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫.৪ শতাংশ। ২০১৫ থেকে ২০১৯ সময়কালের মধ্যে গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭.৪ শতাংশ। তখন ভারতে গড় প্রবৃদ্ধি ৬.৭ শতাংশ এবং পাকিস্তানে ৫ শতাংশের নিচে এবং মালয়েশিয়ায় গড় প্রবৃদ্ধির হার মাত্র ৪.৯ শতাংশ।

এ ছাড়াও বাংলাদেশ প্রতিনিয়তই উন্নয়ন আর অগ্রগতির নতুন মাইলফলক স্পর্শ করছে। দেশটি নিজেই নিজের রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড আর ইতিহাস গড়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাতে উন্নয়ন নতুন করে আশার আলো দেখাচ্ছে। বিশ্বের ১৫৩টি দেশের মধ্যে এখন বাংলাদেশের অবস্থান ৫০তম। ডব্লিউইএফ-এর বৈশ্বিক নারী-পুরুষের বৈষম্য প্রতিবেদনে এমন তথ্যই প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম প্রকাশিত বৈশ্বিক নারী-পুরুষ বৈষম্য হ্রাসে ভালো পারফরম্যান্স করা ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি।

নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ ও সুযোগ; শিক্ষা, স্বাস্থ্য-সুরক্ষা এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন- এ চার সূচক দিয়ে কোনো দেশে নারী-পুরুষের বৈষম্য কেমন, তা নির্ধারণ করা হয়। তালিকায় শীর্ষ স্থানে আছে আইসল্যান্ড। দুই ধাপে পেছানোর পরও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের ওপরে অবস্থান বাংলাদেশের। এ তালিকায় যুক্তরাষ্ট্র ৫৩তম অবস্থানে রয়েছে। গত কয়েক দশকে নারী-পুরুষের বৈষম্য কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বেশ এগিয়েছে। মাত্র এক যুগের ব্যবধানে ৪১ ধাপ এগোলো বাংলাদেশ।

অন্যদিকে একই সময়ের ব্যবধানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২৩তম স্থান থেকে ৩০তম ধাপ পিছিয়ে ৫৩তম স্থানে নেমেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এ রকম পিছিয়ে পড়ার কারণ, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের অংশগ্রহণ ও সুযোগ এবং স্বাস্থ্য-সুরক্ষা সূচকে দেশটির অবনতি হয়েছে। বাংলাদেশ শুধু যে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে এগিয়ে আছে বিষয়টি এমন নয়; বরং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ।

সম্প্রতি নারী-পুরুষের বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি বিশ্বসভায় প্রশংসিত হয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ নারী-পুরুষের বৈষম্য ৭২ শতাংশের বেশি কমিয়ে এনেছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে ভালো পারফরম্যান্স করা দেশ।

বাংলাদেশে শিশুর জীবনমানের বিচারেও অগগ্রতি হয়েছে চোখে পড়ার মতোই। ২০০৮ সালে শিশু মৃত্যুহার ছিল প্রতি হাজারে ৫৬ জন। বর্তমানে প্রতি হাজারে মাত্র ৩১ জন। এটি শুধু অগ্রগতি নয়, বরং বিশাল অর্জন। এত উন্নয়ন আর অগ্রগতির মধ্যে বাংলাদেশের মানুষের জন্য আরেকটি সুসংবাদ হচ্ছে- এ দেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। বর্তমানে ভারতের মানুষের গড় আয়ু ৬৯ বছর এবং পাকিস্তানের ৬৭ বছর। অথচ বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বর্তমানে ৭৩ বছর। বেড়েছে নারীর ক্ষমতায়ন ও সামাজিক গতিশীলতা। সামাজিক সুরক্ষাও দিন দিন উন্নত হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশ প্রতিটি ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় সফলতা দেখিয়েছে। সেক্ষেত্রে অনেক উন্নত দেশ তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে পড়ছে। তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এসব জরিপের মাধ্যমে কোনো দেশের পুরো চিত্র তুলে আনা সম্ভব না। এ সমস্ত সূচক যতই পদ্ধতিগতভাবে শুদ্ধ হোক না কেন, এটা সামগ্রিকভাবে একটি রাষ্ট্রের চিত্র উপস্থাপন করে না। অপরদিকে জরিপের ফলাফল অনেকটা নির্ভর করে দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। গোপন উদ্দেশ্যের ওপর।

এ বিষয়ে মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও গবেষক রফিকুজ্জামান জানান, এসব জরিপ যতই পদ্ধতিগতভাবে শুদ্ধ হোক না কেন, এটা সামগ্রিকভাবে একটি রাষ্ট্রের বাস্তব চিত্র উপস্থাপন করে না। আমি নিজেও গবেষণার সঙ্গে যুক্ত। জরিপের ফলাফল মূলত নির্ভর করে দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। একই জরিপ কখনো নেতিবাচক আবার কখনো ইতিবাচক হিসেবে উপস্থাপন করা যায়। অনেক সময় এটি রাজনৈতিক এজেন্ডা হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ সামগ্রিকভাবে উন্নয়ন হচ্ছে। আমরা পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ করে নিজেদের সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছি। জাতিসংঘের এসডিজি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সবচেয়ে ভালো করেছে। ইতোমধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উতরে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। এরমধ্যে হয়তো কিছু বিষয় উপেক্ষিত হয়েছে, সে জন্য এ বিরাট অর্জনকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। এ ধরনের জরিপে সামাজিক ও মানসিক পুরো চিত্রটা উঠে আসে না। অতএব এ ধরনের জরিপকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন মনে করি না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, সুখের বিষয়টি অনেকটাই সাবজেক্টিভ। অনেকেরই হয়তো অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ, কিন্তু সে হয়তো সুখেই আছে। যারা গান-বাজনা করেন তাদের লাইফস্টাইল বিজনেসম্যানদের মতো না। কিন্তু তারা হয়তো গানবাজনা করে সুখেই আছেন। আমার কাছে মনে হয় না, এইগুলোকে গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন আছে। বিশেষ করে যখন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এগুলো করে। এর কোনো মানে নেই। এগুলো পশ্চিমা দেশে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ফান্ড পেয়ে থাকে। তারা করে। এবং তারা বার বার চেষ্টা করে তাদের উন্নত দেশগুলোই সবচেয়ে সুখী। আসলে উন্নত দেশগুলোর মধ্যেই দুঃখ কম। আমি মনে করি না, এর মধ্যে কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে।

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

আরও খবর

Video