জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে জানাই নূতুন বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা ও অকৃত্রিম অভিনন্দন সাথে এক বুক ভালবাসা। ছোটদের স্নেহাশিস, বড়দের প্রণাম,আদাব,সালাম।
নূতুন বছর ১৪৩১ বাংলা, ২০২৪ ইং সবার জীবন আনন্দে ভরে উঠুক, সবার মন – মানসিকতা সমৃদ্ধি ও উজ্বল হোক উন্নত হোক সবার হৃদয় । সবাই রোগ- শোক,দুঃখ -ব্যাধি থেকে মুক্ত থাকুন। সবার মন আনন্দে উদ্বেলিত হোক,মুছে যাক গ্লানি, সতেজ সবুজ হোক এই ধরাধাম। অশুভ শক্তির বিনাশ শুভশক্তির প্রাদুর্ভাব হোক সৃষ্টিকর্তার কাছে আকুল প্রার্থনা।
মাঘ ফাল্গুন মাসের দিকে নূতুন বছরের নূতুন পঞ্জিকা বের হয়, আশ্চর্য পণ্ডিতেরা লাল কাপড় বেষ্টিত পঞ্জিকা নিয়ে গণনার জন্য চৈত্রমাস আসার সাথে সাথেই বাড়ীতে বাড়ীতে গিয়ে গণনার কাজ শুরু করেন, পঞ্জিকায় নূতুন বছর কিভাবে যাবে দেশ -বিদেশের খবর থেকে শুরু করে বিশ্ব পরিস্হিতি রাজনীতি, অর্থনীীতি সংঘাত,বন্ধুত্ব, রোগ – ব্যাধি,বন্যা, খরা,দূ্র্যোগ,দুর্ভিক্ষ,আবহাওয়া, ইত্যাদি সন্নিবেশিত থাকে। নূতুন বছর কোন রাশি কি অবস্হান তা রাশিফল থেকে জানা যায়। প্রতিদিন কার জীবন প্রতিক্ষণ সব কিছু পঞ্জিকায় উল্লেখ থাকে। ব্যক্তিগত আয়- ব্যয়, রোগ ব্যাধি, শত্রুভয়, মৃত্যুভয়, নূতুন শত্রুভাব, মিত্রতা, চাকুরী, ব্যবসা, শিক্ষা, টাকা- পয়সা লেনদেন সহ প্রতিকার,প্রতিযেধক, প্রতিরোধ ব্যবস্হা উল্লেখ থাকে। প্রতিটি বাঙ্গালীর অনেকে এই প্রথা মেনে চলে।
বলা হয় হিন্দুদের বার মাসে তের পার্বণ।
চৈত্র মাস আসার সাথে সাথেই ঢুলিয়া ঢোলক নিয়ে শিব – গৌরি সাজায়ে প্রতি পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ঘুরে গাজন গেয়ে গেয়ে মানুষকে আনন্দ প্রদান করে থাকে।তাদের পিছুপিছু ছেলেরাও নাওয়া খাওয়া ছেড়ে ছুটে বেড়াই। এ সময় গৃহস্হ বাড়ীতে কাজের ধূমধাম পরে যায়। শীত বস্ত্র,কাঁথা – কম্বল,লেপ – তোযক,মশারি ইত্যাদি ধোঁয়া মুছা, বাড়ী পরিষ্কার করা থেকে শুরু করে বাড়ী ঘরে ঝাড়ু দেওয়া দরজা জানলা, যাবতীয় আসবাব পত্র পরিষ্কার – পরিছন্ন করা, এককথায় নূতুন বছরে সবকিছু নূতুন করে সাজানো। ময়লা আবর্জনা পুরিয়ে নিত্য নূতুন সামগ্রী দিয়ে পরিপাটি করে তোলা। নূতুন বছরকে বরন করতে দেহ- মন শুদ্ধ করার নিমিত্তে নাপিতের মাধ্যমে নখকুটা করে পুরানো বছরের রান্না করা ভাত- তরকারি ডেকচী, পাতিল সহ সব ধরনের এঁটো জাতীয় বস্তু পানি দিয়ে পরিষ্কার করে নেওয়া। গরু,ছাগল পালিত পশুদের স্নান করানো।
পুরানো বছরের শেষের আগের দিন ( তারিখ উল্লেখ নাই কারন চৈত্র মাস কখনো কখনো ৩১ দিনে হয়) ফুল বিষু পর্ব, ঐদিন বিষু ফুল, হার গ্যাঁজা ফুল ( বছরে ১ বার ফোটে নিদিষ্ট সময়) নিমপাতা দিয়ে বাড়ী ঘর সাজানো হয়। সকাল সন্ধ্যায় প্রতি ঘরে ঘরে ধূপ ধূনো দিয়ে পবিত্র রাখা হয়। এসব কিছু বিজ্ঞান ভিত্তিক স্বাস্থ্যপ্রদ কর্মযজ্ঞ। এসব মানবজীবনের জন্য প্রয়োজনীয় কাজ। নিমপাতার বাতাস স্বাস্থ্যপদ এছাড়াও পোকা – মাকড়ের প্রাদুর্ভাব কমে যায়। অনেকে ঘরে বিশেষ লাইটিং এর ব্যবস্হা করে। সরকারী বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আলোক সজ্বা করা হয়।
চৈত্র মাসের শেষ দিন দেহ মনে পবিত্রতার সাথে নূতুন বছরকে আলিঙ্গন করার সব প্রস্ত্ততি গ্রহন করা হয়। ১ লা বৈশাখ অনেকে নূতুন বস্ত্র পরিধান করে, মঙ্গল শোভাযাত্রা অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহন করে, সেখানে বাঙ্গালীর বিভিন্ন ঐতিহ্য মণ্ডিত প্লেকার্ড,ফেস্টুন, ব্যানার নিয়ে বিভিন্ন প্রদর্শনী, রাস্তায়, মঞ্চে ” এসো হে বৈশাখ “, গুনগুন শব্দে চারিদিকে আনন্দের সুবাতাস শুভ বার্তা ছড়িয়ে দেয়। অনেক সাংস্কৃতিক সংঘটন বিভিন্ন আনন্দ দায়ক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। রেডিও, টেলিভিশন বৈচিত্র্যময় অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। দেশের পত্রিকা সমূহ বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে, ম্যাগাজিন সমূহ বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে।
নূতুন বছরের আগের দিন চৈত্রের শেষদিন যা মকড় সংক্রান্তি তিথি হিসেবে পরিগণিত, ঐ দিন দোকান পরিষ্কার পরিছন্ন করে ফুলে – ফলে সাজানো হয়, এবং পরের দিন ১ লা বৈশাখ দোকানে -পূজা করে নূতুন খাতায় সৃষ্টিকর্তার নাম লিপিবদ্ধ করে নূতুন বছরকে স্বাগত জানিয়ে ব্যবসা – বাণিজ্য, বানিজ্যে বসতি লক্ষ্মী স্মরনে রেখে দিনের সূচনা করে। সকাল সকাল যারা যেতেন সবাইকে চা- মিষ্টি মুখ করানো হয়, বিগত বছরের বকেয়া থাকলে তা পরিশোধ করে। আজ বেচা বিক্রি কম হয়, কারন সবার ধারনা বছরের ১ ম দিন খরচ করলে সাড়া বছর খরচ করতে হয় তাই অনেকে আগের দিন বাজার করে নেয়। প্রায় বাঙ্গালীর ঘরে মাছ,মাংস পোলাও ভাল ভাল খাবার পঞ্চ ব্যঞ্জন রান্না হয়।অনেকে মেহমানদারী করে,বিশেষত ব্যবসায়ীরা আজ সাড়া বছরের জন্য কাষ্টমার ঠিক রাখতে অনেক আপ্যায়নের ব্যবস্হা থাকে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠানের নামে নান্দনিক ক্যালেন্ডার উপহার দিয়ে থাকে। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ যে যাকে যেখানে পায় দোকানে আসার নিমতন্ন বা দাওয়াত দেয়,একে অপরের সাথে কোলাকুলি, আলিঙ্গন নমস্কার, সালাম, আদাব ইত্যাদি খুশী মনে আদান প্রদান করে। আজ দোকানে জিনিযের দাম কষাকষি নাই। দোকানীরা বেশী নেয় না,খরিদদারও দাম কষাকষি করে না। অনেক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান নূতুন বছর উপলক্ষ্যে নিদিষ্ট পণ্যের উপর ছাড় দেয়,এই সুবাদে তাদের বিক্রি বেড়ে যায় খরিদদারেরাও লাভবান হয়।
চৈত্র মাসের শেষ দিনের আগের দিন , সন্ধ্যায় হিন্দু, বৌদ্ধ সম্প্রদায় লোকেরা বাড়ীর উঠানে ৪/৫ রকমের ঔষধি গুল্মলতা আগুন জ্বালায়ে তার ধোঁয়া গ্রহন করে, এতে শরীরের খস, পাঁচড়া ইত্যাদি দুষিত পদার্থ দূর হয়। এভাবে তিন বার ধোঁয়া জ্বালানো হয়। সাথে সাথে আঞ্চলিক ভাযায় নানা রকমারি সুরে নূতন বছরের কাছে টাকাকড়ি ধন দৌলত সুখ – শান্তির বর চাওয়া হয়। রোগ মুক্তি কামনা ও বিভিন্ন অশুভ শক্তি বিনাশের প্রার্থনা করা হয়। মুসলিম সম্প্রদায়ের নারী – পুরুষ,ছেলে- মেয়ে এসব সংস্কৃতি দেখতে আসে, দেখে তারাও আনন্দ উপভোগ করে।
প্রতি হিন্দু ঘরে জলপানের ব্যবস্হা থাকে মুড়ির সাথে নানা ধরনের উপকারী উপাদেয় দানাদার শস্য মিশায়ে, জল খাবার তৈরী করা হয়। খইয়ের ছাতু, কড়ইয়ের গুড়া, চিড়ার মোয়া,মুড়ির মোয়া , রাঙ্গাআলুর জিরার নাড়ু , চালের গুড়ার জিরার নাড়ু, বড়ইয়ের নাড়ু, নারিকেলের সন্দেশ ইত্যাদি খেজুরগুড় দ্বারা উত্তম উপাদেয় খাবার তৈরী করা হয়। দই দিয়ে মেখে এই সুস্বাদু তন্দুরি খাবার খেতে কতই না আরামদায়ক ও মজাদার। সকালে ঘাটগিলা ( এক ধরনের ঔষধি ) ও কয়েক পুকুরের জল, নদীর জল মিশ্রিত করে তা মাথায় দিয়ে স্নান করে শত্রু নিধন প্রক্রিয়া শেষ করে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরন করে পিতা- মাতার আশীর্বাদ নিয়ে দিনের কাজ শুরু হয়। ছোটরা পাড়ার বড়দের খুঁজে খুঁজে প্রণাম করে আশীর্বাদ নিতে দলবেঁধে বেড়িয়ে যায়।
বছরের শেষদিন সম্ভবতঃ প্রতিটি বাঙ্গালী পরিবারে পাঁচন রান্না করা হয়। নানা ধরনের পুষ্টিগুণ সস্পন্ন কাঁচা সবজ্বি বিশেষত ঔষধি গুল্ম জাতীয় লতাপাতা শাক ইত্যাদি যেগুলো মৌসুমে পাওয়া যায় যা মানব শরীরের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও নির্ভরযোগ্য প্রতিযেধক । নানান জাতীয় শস্য দানা, মসলা সমেত খুব পাক পবিত্র হয়ে রান্না করা হয়। এতে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এই পাঁচন শরীরের নানা রোগের উপশম করে।
মেলার খবর বাজারে ঢোল দিয়ে প্রচার করা হতো। বিভিন্ন স্হানে মেলা বসত এখন সব কিছু শহর কেন্দ্রিক হওয়ায় মেলার অস্হিস্হ বিলীন হয়ে গেছে, মেলায় গরুর লড়াই, কুস্তী ধরাধরি পুতুল নাচ,যাদু প্রদর্শনী, সাপের নাচ টকি সিনেমা, যাত্রা ইত্যাদি হচ্ছে বাংলা ও বাঙ্গালীর ঐতিহ্য সংস্কৃতি।
আয়োজনে থাকত বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলা কাবাডি, গোল্লাছুট, ডাংগুলি, হাডুডু,কানামাছি, নৌকা – বাইচ,লুডু, ছিছিছি, মোরগ লড়াই, কুতকুত, বউচি, দাড়িয়াবান্ধা, ঘুড়ি উড়ানো, বাঘ- ছাগল ইত্যাদি।
প্রচণ্ড তাপ দহে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠে অনেকে ছাতা নিয়ে বের হয়। কবির ভাষায়
ঘাম ঝরে
দরদর
গ্রীষ্মের দুপুরে
খাল বিল
চৌচির,
জল নেই পুকুরে।
মেলায় বা দোকানে ঠাণ্ডাপানীয়, মাঠা, আইসক্রিম, শরবত, লাচ্ছি বাকী তরমুজ বিপুল পরিমানে বিক্রি হয়। মেলায় দেশীয় হস্তসামগ্রী বিপুল পরিমানে বিক্রি হয় । সাড়া বছরের জন্য গৃহস্হালী সামগ্রী ঝাড়ু, কুলা, লাই,খায়াং, মাটির জিনিষ থেকে শুরু করে আসবাব পত্র খাট, চেয়ার টেবিল ইত্যাদি পর্যন্ত দেখা মিলে। বাচ্চাদের নিত্যনতুন খেলনা, পুতুল, মহিলাদের নানান ডিজাইনের সাজনের জিনিষ ইত্যাদিতে ভরপুর থাকে।
যাত্রা গানের পাশাপাশি থাকত অবৈধ জুয়া খেলার আড্ডা, অনেকে সর্বশান্ত হয়ে মুখ বেজার করে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরত। ক্ষেত্র বিশেষে পকেট মার চুরি চামারিও হয়।
আজ তথ্যপ্রযুক্তির যুগে আমাদের ঐতিহ্য কালের গর্বে বিলীন হতে বসেছে। আমরা পাশ্চাত্য শিক্ষা, সংস্কৃতি, সভ্যতাকে নিয়ে তাকে লালন পালন ধারন করি,কিন্ত নিজের দেশের কৃষ্টির প্রতি আমাদের নজর নেই। সাম্প্রদায়িকতা ও ক্ষমতার জন্য লড়াই করে আমাদের অস্হিস্হ বিলীন হতে বসেছে। আমরা বাঙ্গালী, বাংলা আমার ভাযা আমার দেশ , হিন্দু – মুসলিম – বৌদ্ধ – খৃষ্টান আমরা এক মায়ের সন্তান। আমাদের ধর্ম আলাদা হতে পারে কিন্ত দেশ সবার। এ পৃথিবীর আলো বাতাস, পানি, সাগর, নদ- নদী আকাশ সৃষ্টিকর্তা সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন, আমরা কেন পৃথক হবো। ভাষা,শিক্ষা, সভ্যতা, সংস্কৃতি, স্বাধীনতার জন্য মুক্তিষুদ্ধ হয়ে শহিদ হয়েছেন , অনেক রক্ত, মা- বোনের ইজ্বতের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন ,তা প্রজন্মকে সঠিক ভাবে ইতিহাস জানাতে হবে,না হয় জাতি হিসেবে আমরাও বেঈমান হয়ে থাকব ।
লেখক- অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক ।
মন্তব্য করুন