বৃহস্পতিবার, ২০২৫ মে ০১, ১৭ বৈশাখ ১৪৩২
#
জাতীয় জাতীয়

মহাসড়কে চলছে রেস নৈরাজ্য, ঝরছে প্রাণ

টুয়েন্টিফোর টিভি
প্রকাশিত : সোমবার, ২০২২ সেপ্টেম্বর ২৬, ০২:০১ অপরাহ্ন
#

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় এক ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে চলতি বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর। এরপর মধ্যরাতের ওই দুর্ঘটনার কিছু ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। যে বাসটি দুর্ঘটনাটি ঘটিয়েছে সেই বাস এবং তার পেছনে থাকা অপর একটি বাস থেকে চালককে উসকানি দিয়ে রেসের ভিডিও করা হয়। বিষয়টি সামনে আসার পর দেশের পরিবহন খাতের নৈরাজ্যের চিত্র যেমন ফুটে উঠেছে, তেমনি প্রতীয়মান হয়েছে তরুণ প্রজন্মের মানসিক বিকৃতির।

জানা যায়, ১৫ সেপ্টেম্বর রাতে ঢাকা থেকে বান্দরবানে ঘুরতে যান কিছু তরুণ। যারা বাস লাভার নামে পরিচিত এবং তাদের ফেসবুকভিত্তিক গ্রুপ ‘বিডি বাস জোন’ ওই ট্যুরের আয়োজন করে। ৪৫ জন সদস্যের ওই গ্রুপটি হানিফ এন্টারপ্রাইজ থেকে ট্যুরের জন্য একটি বাস ভাড়া নেয়। ট্যুর শেষে ১৬ তারিখ শুক্রবার রাতে ওই বাসটি নিয়ে তারা ঢাকায় ফিরছিল। শুরু থেকেই বেশ বেপরোয়া ছিলেন সদস্যরা। তারা বাসের ইঞ্জিন কাভারে (বনেট) বসে চালককে দ্রুতগতিতে যাওয়ার জন্য উসকানি দিতে থাকেন বলে জানা যায়।


কয়েকজন ট্যুর সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাত ৩টার দিকে বাসটি যখন কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় আসে, তখন তারা ইমাদ পরিবহনের একটি বাস দেখতে পান। ওই বাসটিও ছিল ট্যুরের। ইমাদ পরিবহন অফিশিয়াল ফেসবুক গ্রুপের সদস্যরা কক্সবাজার থেকে ঢাকায় ফিরছিলেন। ওইদিন একসঙ্গে বিভিন্ন গ্রুপের ছয়টি বাস ঢাকায় ফিরছিল। এরপরই হানিফ আর ইমাদ পরিবহনের দুটি বাসের মধ্যে কে কার আগে যাবে, তা নিয়ে চলে প্রতিযোগিতা।

বাস থামিয়ে ‘ফেয়ার খেলা’র আহ্বান

এভাবে দুই বাসের প্রতিযোগিতা চলার একপর্যায়ে হানিফের বাসে থাকা ট্যুরের সদস্যদের কথামতো চালক সজল ইমাদের বাসের চালককে হাত দিয়ে ইশারা দেন বাসটি থামানোর জন্য। তখন ইমাদের সামনে থাকা ট্যুরের সদস্যদের কথায় বাসের চালক হানিফের পাশে বাসটি থামান। তখন হানিফ থেকে তাদের ‘ফেয়ার খেলা’র আহ্বান জানানো হয়। এতে উত্তেজিত হয়ে ওঠেন ইমাদ পরিবহনে থাকা সদস্যরা। তারা চালককে দ্রুত বাস চালাতে বলেন এবং আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন। কিন্তু দুটি বাস চলতে শুরুর পরই ইমাদের সামনে একটি লরি থাকায় হানিফের বাসটি বাম লেন থেকে আগে চলে যায়।  এরপর আবার হানিফ গতি একটু কমিয়ে দিলে ইমাদ আগে চলে যায়।
 

 

No description available.

চলার পথে বাস থামিয়ে ‘ফেয়ার খেলা’র আহ্বান জানাচ্ছেন হানিফ এন্টারপ্রাইজের চালক। ভিডিও থেকে নেয়া ছবি।


একপর্যায়ে হানিফের ওই বাসটি আবার ইমাদ পরিবহনের বাসকে ওভারটেক করে সামনে চলে আসে। তখনকার ভিডিও থেকে দেখা যায়, হানিফের ওই বাসের সামনে ছিল একটি মালবাহী ট্রাক। আর বাসটি কোনো কারণ ছাড়াই ‘বাউলি’  দিচ্ছিল। (আরেকটি গাড়িকে ওভারটেক করতে গিয়ে বাস যখন দ্রুতগতিতে একাধিকবার লেন বদল করে, পরিবহন শ্রমিকদের ভাষায় তাকে বলে ‘বাউলি’)। আর ট্রাকটিকে ওভারটেক করতে হর্ন দেয়ার পাশাপাশি ‘ডিপার’ (সামনে থাকা বা বিপরীত দিক থেকে আসা কোনো যানবাহনের চালককে সংকেত দিতে হেডলাইটের ব্যবহার) দিচ্ছিল হানিফের চালক সজল।


ডিপার দেখে সামনে থাকা ট্রাকটি প্রথমে হালকা ডানে চাপ দিলেও পরে আবার বাম লেনে চাপতে থাকে। ঠিক তখনই ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে থাকা হানিফ এন্টারপ্রাইজের ওই বাসাটি ট্রাককে ওভারটেক করতে গিয়ে সজোরে ধাক্কা দেয়। এতে বাসের বাম পাশের অংশ দুমড়ে-মুচড়ে যায়। যদিও তাতে কেউ গুরুতর আহত হননি। কিন্তু ট্রাকটি মুহূর্তেই সড়কে উল্টে যায়। বিষয়টি দেখার পরও ওই বাসের সামনে থাকা তরুণরা বাসটি না থামিয়ে বা আহত ট্রাকচালক-হেলপারকে উদ্ধার না করে বাসচালককে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করতে বলেন।


এদিকে দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে পেছনে থাকা ইমাদ পরিবহনের বাসে থাকা ট্যুরের অন্য সদস্যদের মধ্যে কয়েকজন হানিফে থাকা ‘বিডি বাস জোন’-এর সদস্যদের ফোন করে নিশ্চিত করেন ট্রাকের চালক-হেলপার বেঁচে আছেন। এতে হানিফ বাসে থাকা ট্যুরের সদস্যরা স্বস্তি পান এবং দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন–এমনটাই জানান পরিচয় গোপন রাখার শর্তে হানিফ পরিবহনে থাকা ‘বিডি বাস জোন’-এর এক সদস্য।


যদিও ১৫ তারিখ ট্যুরে যাওয়ার আগে এই দুটি গ্রুপের সদস্যরা ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে নিজেদের শক্তিশালী হিসেবে আখ্যায়িত করেছে এবং একে অন্যকে ট্রল করেছে। এমনকি চালকের নাম লিখেও তারা এক গ্রুপ অন্য গ্রুপকে উসকানি দিয়েছে। এ সংক্রান্ত বেশ কিছু তথ্য-প্রমাণ সময় সংবাদের হাতে আছে। শুধু ওই ট্যুরেই যে এমন হয়েছে তা নয়, মাঝে মাঝেই তারা এমন ট্যুরের আয়োজন করে শুধু কোন গ্রুপের চালক কতটা ‘পাঙ্খা’ এবং কোন কোম্পানির বাস গতিতে সেরা সেটা প্রমাণের জন্য।


কিন্তু প্রতিযোগিতা করেননি বলেই দাবি করেছেন ট্যুরের অন্যতম সংগঠক এবং ‘বিডি বাস জোন’-এর অ্যাডমিন ইমরান ইমু। তারা প্রতিবছরই এমন ট্যুর করে থাকেন। কখনোই এমন ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু এবার দুর্ঘটনা হয়ে যাওয়ায় বিষয়টি বড় হয়েছে বলে দাবি তার।


একই রকম দাবি করেন শুভ নামে অপর এক সদস্য। মিরপুরের এ বাসিন্দা জানান, ওইদিন চালককে কেউ উসকানি দেয়নি। তিনি তার মতোই চালাচ্ছিলেন। শুধু তাই নয়, দুর্ঘটনার সময় বাসের গতি ঘণ্টায় মাত্র ৬০ থেকে ৭০ কিলোমিটার ছিল বলেও দাবি করেন তিনি।


দুর্ঘটনার জন্য ট্রাকের চালককে দায়ী করে তিনি বলেন, ‘ট্রাক প্রথমে মাঝামাঝি লেনে ছিল আর আমাদের বাস বাম লেনে। কিন্তু ওভারটেক করার ঠিক আগমুহূর্তে ট্রাকটি প্রথমে হালকা ডানে এবং পরে বাম লেনে চাপতে থাকলে আমাদের চালক ‍দুর্ঘটনা হবে বুঝতে পেরে ডান লেনে বাউলি দিয়ে বের হয়ে যেতে চেষ্টা করেন। কিন্তু তখন ট্রাকের সঙ্গে ধাক্কা লাগে।’


যদিও ঘটনার সময়ের ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, হানিফ এন্টারপ্রাইজের বাসটির দ্রুতগতির কারণেই এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে। যদিও দুর্ঘটনার পর সমালোচনা শুরু হলে ওই সংক্রান্ত ভিডিওগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে সরিয়ে ফেলেছেন আপলোডকারীরা। এমনকি নিজেদের মধ্যে কথা বলার জন্য গড়ে তোলা মেসেঞ্জার গ্রুপেও ওইসব ভিডিও কোথাও না ছাড়তে সতর্ক করা হয়েছে এবং কিছুদিন এমন রেসিং ভিডিও না দিতে ও ট্যুর না দিতেও অনুরোধ করা হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন গ্রুপে যদি কেউ অ্যাডমিন বা মডারেটর থেকে থাকেন, তাহলে তাদের ওইসব গ্রুপ থেকে বের হয়ে যেতে অনুরোধ করেছেন ইমরান ইমু। বলেছেন, এখন আর বাস লাভিং করতে হবে না, একসঙ্গে বসে আড্ডা দেয়া আর চা খাওয়ার সময় সব বিষয়ে কথা হবে। যার স্ক্রিনশটও সময় সংবাদের হাতে এসেছে।


বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে ৫৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর জন্য। আর চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে ৩৭ শতাংশ। পরিবেশ-পরিস্থিতিসহ অন্য কারণে দুর্ঘটনার পরিমাণ ১০ শতাংশ।

 

No description available.


‘ওরা উড়ে’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউবে ভয়ংকর এই বাস দুর্ঘটনার ভিডিও শেয়ার হওয়ার পর নানা ধরনের মন্তব্য দেখা গেছে। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই সড়ক ও পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, মহাসড়কে বাসচালকরা নিজেদের বিমানচালক মনে করেন।


হাসান ইমতিয়াজ ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে হানিফ এন্টারপ্রাইজ বাসের একজন নিয়মিত যাত্রী হিসেবে লিখেছেন, ‘মহাসড়কে হানিফের ড্রাইভাররা তো রীতিমতো উড়তে থাকে। রাতের বেলা তাদের বাস ড্রাইভিং আর প্লেন চালানোর মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য নাই, ওরা উড়ে।’


বোরহানুল কবির নামে একজন মন্তব্য করেছেন, ‘রাস্তায় আপনারা রেস করবেন, না গোল্লাছুট খেলবেন, সেগুলো আপনাদের বিষয়। কিন্তু প্লিজ আমাদের নিরাপদে ঘরে ফিরতে দিয়েন। আর কোন দিন কে এক্সিডেন্ট করবেন, সেটা জানতে পারলে যাত্রীদেরও সতর্ক করে দিয়েন সেদিন।’


মহাসড়কে ওভারটেক নিয়ে বাজি ও চ্যালেঞ্জ


দেশের দূরপাল্লার বাসগুলো প্রধানত সায়দাবাদ, গাবতলী ও মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে যায়। এসব এলাকায় কান পাতলে বেশ কয়েকজন বাসচালকের নাম শোনা যাবে যারা ‘পারাপারি’, ‘চাপ’ এবং ‘বাউলি’র মতো ঘটনায় বেশ সিদ্ধহস্ত। এদের মধ্যে ঢাকা-খাগড়াছড়ি রুটে জসিম ওরফে বাউলি জসিম এবং সালাহউদ্দিন ওরফে সাল্লুর বেশ নামডাক আছে। আর ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে ইকবাল, ফারুক, হান্নান এবং বরিশাল রুটে হায়দার আলী বেশ জনপ্রিয়। মূলত এসব চালকসহ আরও কয়েকজনকে নিয়েই বাজিগুলো ধরেন বাস লাভার গ্রুপের সদস্যরা। এমন বহু ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে আছে, যা দেখলে সাধারণ মানুষের গা শিউরে উঠবে।


যদিও চালক জসিম এসব বাজির বিষয়ে কিছুই জানেন বলে দাবি করেন। তিনি নিজের মতোই বাস চালান, যখন যতটুকু গতি তোলা প্রয়োজন মনে করেন, সেভাবেই গতি তোলেন। কারো সঙ্গে পারাপারি করেন না। তবে, সামনের গাড়ির গতি কম থাকলে ওভারটেক করে আগে যাওয়া স্বাভাবিক বলেই দাবি তার।

 

No description available.

এখানে শ্যামলীর একটি বাস দেখা যাচ্ছে যার হেড লাইট বন্ধ, এই বাসটি চালাচ্ছেন চালক জসিম ওরফে বাউলি জসিম। সামনের বাসটি ওভারটেক করতে মাঝে মাঝেই এমন কৌশল নিয়ে থাকেন চালকরা। এতে যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ভিডিও থেকে নেয়া ছবি।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বাজি ধরেন এমন দুজন যুবকের সঙ্গে কথা হয় সময় সংবাদের। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে তারা ঘটনার বিস্তারিত জানান। বলেন, যেসব চালককে নিয়ে বাজি বা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া হয়, তারা একে অন্যের পরিচিত থাকেন। ফলে একটি নির্দিষ্ট দিনে কোন বাসে কোন চালক যাচ্ছেন, তারা আগে থেকেই খবর পান। সে অনুযায়ী চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া হয়। এরপর নারায়ণগঞ্জ পার হয়ে শুরু হয় পারাপারি, যা কখনো কখনো যাত্রার শেষ পর্যন্ত চলে।


তারা জানান, ঢাকা থেকে যাওয়ার সময় যদি একবার কেউ বাজিতে বা চ্যালেঞ্জে হেরে যায় অর্থাৎ, ওটি (ওভারটেক) খেয়ে আবার যদি আগে যেতে না পারে, তখন ওই ক্ষোভ থেকে আবার ফেরার সময় সড়কে পারাপারি চলে। এভাবেই দিনের পর দিন চলতে থাকে। যদিও সবসময় চালকদের নিয়ে বাজি ধরেন না বাস লাভার চক্রের সদস্যরা। কখনো কখনো নিজেদের মধ্যেও বাজি ধরে থাকেন। চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন বাসে উঠে তারপর চালককে উসকানি দিয়ে বেপরোয়া গতিতে বাস চালাতে উৎসাহিত করে থাকেন। ইউটিউব ও ফেসবুক চ্যানেলে ‘বাসের রেস’, ‘সেরা বাউলি’, ‘বাউলি মাস্টার’ ইত্যাদি নামে বহু ভিডিও রয়েছে। দেশের তরুণরা এসব ভিডিও প্রকাশ করেছেন।


চেষ্টা করেও ব্যর্থ!

যাত্রীদের ঝুঁকিতে ফেলে মহাসড়কে বাস নিয়ে চালকদের এই আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতা অনেক চেষ্টা করেও থামানো যাচ্ছে না। বাস মালিকরা বলছেন, বাসে ‘গভর্নরস সিল’ লাগিয়ে, শাস্তি দিয়ে, প্রশিক্ষণসহ সব রকম চেষ্টা করেও চালকদের গতি নিয়ন্ত্রণে তারা সফল হতে পারেননি।


আবার যাত্রীদের অনেকের বিরুদ্ধে বাস শ্রমিকদের দ্রুতগতিতে চালাতে উসকে দেয়ারও অভিযোগ আনছেন মালিকরা। এ কারণে কয়েকটি কোম্পানির বাসের ভেতর ভিডিও ধারণ না করার বিজ্ঞপ্তিও টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে। তাতেও খুব একটা সুফল মিলছে না।


সম্প্রতি এনা ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডের বাসে কোনো যাত্রী ভিডিও ধারণ করতে পারবেন না এবং চালকের পাশে বসে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালাতে উৎসাহিত করা যাবে না–এমন একটি বিজ্ঞপ্তি এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাসছে। যদিও এ বিজ্ঞপ্তি প্রায় দেড় বছর আগের।


বাংলাদেশ ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও এনা পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলছেন, ‘আমরা কম গতি রেখে যাত্রীদের নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে চাইলেও কিছু যাত্রী সবসময়ই চালকদের অতিরিক্ত গতিতে বাস চালাতে উৎসাহিত করছেন। বিশেষ করে খুলনা অঞ্চলে আমরা এমন অভিযোগ শুনছি। এক্সপ্রেসওয়েতে অন্য বাসগুলো যখন এনার বাসকে ওভারটেক করে চলে যায়, তখন কিছু যাত্রী বেশ বিরক্তি প্রকাশ করেন। তারা চালকদের বলতে থাকেন, গরুর গাড়ি চালাচ্ছে, আরও জোরে বাস চালাতে। তবুও আমাদের চালকরা মাথা ঠান্ডা রেখেই নির্দিষ্ট গতিতে বাস চালানোর চেষ্টা করেন।’


এ সময় তিনি যাত্রীদেরও সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান। বলেন, ‘শুধু চালকদের দোষ দিয়ে সবসময় হয় না। যাত্রীদেরও সচেতন হতে হবে। সবার সমন্বিত চেষ্টাতেই মহাসড়ক নিরাপদ হয়ে উঠতে পারে।’


বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির এই নেতা বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ ওভারটেকিং এবং অতিরিক্ত গতিতে বাস চালানোর ফলে বেশির ভাগ দুর্ঘটনা হয়। এ ছাড়া পথচারীর কারণেও অনেক দুর্ঘটনা ঘটে।’

 

No description available.


তিনি বলেন, ‘অনেক চালক আছেন, যারা অনেক গতিতে গাড়ি চালাতে পছন্দ করেন। জোরে গাড়ি চালিয়ে লস ছাড়া কোনো লাভ নেই। দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকে। গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারানোর ঝুঁকি থাকে। গাড়িগুলো দ্রুত লক্কড়-ঝক্কড় হয়ে যায়, গাড়ির মেইনটেনেন্স খরচ বেড়ে যায়।’


গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য গাড়ির ইঞ্জিনে ‘গভর্নরস সিল’ দিলেও চালকরা তা ভেঙে ফেলে। এমনকি স্পিড গভর্নরকে একটা কভার দিয়ে ঢেকে ওয়েল্ডিং করে দেয়ার পরও চালকরা তা ভেঙে ফেলেছে বলে জানান এনায়েত উল্যাহ।


‘গভর্নর’ হলো ডিজেল ইঞ্জিনের তেল সরবরাহ ব্যবস্থায় একটি যন্ত্রাংশ। এর স্ক্রু ঘুরিয়ে ডিজেল সরবরাহ কমিয়ে দিলে ইঞ্জিনের জোর কমে যায়, তাতে উচ্চ গতি তোলা সম্ভব হয় না।


তাই কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ ছাড়া চালকদের এ আচরণ পরিবর্তনের কোনো সুযোগ দেখছেন না এনায়েত উল্ল্যাহ। বলেন, হাইওয়ে পুলিশ যতক্ষণ না কঠোর হবে, ততদিন পর্যন্ত তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।

অন্যদিকে পুলিশ বলছে, বাস মালিকদের কথা ও কাজে মিল নেই। তারা ‘গভর্নরস সিল’ লাগানোর যে কথা বলছে, সেটা অনেকাংশেই সত্যি নয়। অনেকটা সান্ত্বনা দেয়ার জন্য এটা বলে থাকে। শুধু অতিরিক্ত গতি না, চালককে দিয়ে ১৫ থেকে ২৪ ঘণ্টা গাড়ি চালানোর ফলেও দুর্ঘটনা হয় বলে জানান কুমিল্লা অঞ্চলের হাইওয়ে পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।


পরিচয় গোপন রেখে মোবাইল ফোনে তিনি বলেন, ‘রাতের বেলা পুলিশের পক্ষ থেকে গতি পরিমাপ করা সম্ভব হয় না। তবে দিনের বেলা আমরা গতি চেক করি। কিন্তু সেটাও সব গাড়িতে করা যায় না। যদি সব গাড়িতে করতে যাই, তাহলে রাস্তায় জ্যাম লেগে যাবে।  দেখা যায় ৫০টি গাড়ির মধ্যে ৫ থেকে ১০টি গাড়িতে চেক করা হয়। এর মধ্যে স্পিডগানে অতিরিক্ত গতি ধরা পড়লে মামলা দেই বা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়। কিন্তু তাতেও যাত্রীরা বিরক্ত হন। বলেন হয়রানি করা হচ্ছে তাদের।’


তাই সিসি ক্যামেরার মধ্যে গতি শনাক্তের ব্যবস্থার পাশাপাশি নিজেদের সচেতনতার বিকল্প দেখছেন না পুলিশের এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।


সাবধানে চালানোর পক্ষপাতী অভিজ্ঞ চালকরা


গ্রিন লাইন পরিবহনের বাস চালান মিজানুর রহমান। সিলেট-চট্টগাম রুটে তিনি সবচেয়ে বেশি সময় বাস চালিয়েছেন। অভিজ্ঞতার হিসাবে প্রায় ২০ বছর। সার্বিক বিষয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি জানান, সড়কে দ্রুত যেতে সবারই ইচ্ছা হয়। কিন্তু এখানে ধৈর্য অনেক বড় বিষয়। পরিস্থিতি বুঝে বাস চালাতে হবে। দেশের রাস্তার যে অবস্থা, তাতে দ্রুত বাস চালালে গাড়ির ইঞ্জিন, ব্রেক, সিট সবকিছুরই ক্ষতি হয়। আর এই রাস্তায় দ্রুত গাড়ি চালিয়ে নিয়ন্ত্রণ রাখাও কষ্টসাধ্য।


মিজানুর রহমান বর্তমানে গ্রিন লাইনের দোতলা বাস চালান। তিনি বলেন, ‘এই বাসটি তুলনামূলক বড়, ফলে বেশ সতর্কভাবে চালাতে হয়। আস্তে চালানো অনেক যাত্রী পছন্দ করেন না। কেউ কেউ গালিগালাজ করেন। কিন্তু এখানে ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়। রাস্তার পরিস্থিতি যাত্রীরা বোঝেন না, যেটা চালককে বুঝতে হয়। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে দায় আসে চালকের ওপর। ফলে রেস করা যায়, কিন্তু খুব বেশি আগে গন্তব্যে যাওয়া যায় না। সর্বোচ্চ আধা ঘণ্টা আগে কেউ পৌঁছাতে পারে।’


ঢাকা-বগুড়া রুটে চলাচলকারী মানিক এক্সপ্রেসের হুন্দাই চালান রানা। গাড়িগুলোকে তিনি তার জীবনের মতোই ভালোবাসেন। বলেন, ‘এটা দিয়েই আমার ও আমার পরিবারের পেট চলে। এটার কোনো ক্ষতি হলে শুধু মালিকের নয়, আমারও লস। আমার জীবিকা বন্ধ। তাই আমি সবসময় নিজের চিন্তা যেমন করি, তেমনি গাড়ির মালিকের ও যাত্রীদের চিন্তাও করি। ফলে পারাপারি চাইলেও করতে পারি না।’


বাস চালানোর দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের রাস্তার অবস্থা ভালো নয়। হুট করেই যে কেউ গাড়ির সামনে চলে আসে, বা হুট করেই লেন পরিবর্তন করে। তাই পারাপারি করলে বিপদে পড়ার আশঙ্কা অনেক বেশি থাকে। পারাপারি করে কেউ খুব বেশি আগে যেতে পারে না। রাস্তা ফাঁকা থাকলে কাছাকাছি সময়েই সবাই পৌঁছাতে পারে।’


সচেতন করতে ব্যর্থ গ্রুপের সদস্যরাও


একটা সময় বাস লাভারদের বড় গ্রুপ হিসেবে ধরা হতো ‘বাসেস অ্যান্ড কোচেস’কে। শুরুর দিকে বেশ ভালোই চলছিল গ্রুপটি। যেখানে বিভিন্ন বাসের ছবি শেয়ার করার পাশাপাশি বাসের রিভিউ দেয়া হতো। কিন্তু ২০১৮ সালের পর থেকে রেসিং ভিডিও এবং তা নিয়ে বেশ মাতামাতি শুরু হয় বলে জানান গ্রুপটির সিনিয়র একজন অ্যাডমিন। একটা পর্যায়ে তা ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়ে।


পরিচয় গোপন রাখার শর্তে রাজধানীর মিরপুরের ওই বাসিন্দা জানান, গ্রুপের জুনিয়র সদস্যরা চালকদের নিয়ে মহাসড়কে রেস করত। তারা টাকার বিনিময়ে চালকদের নিয়ে যেত। এরপর সেই ভিডিও গ্রুপে আপলোড করত। বহু চেষ্টা করেও এ প্রতিযোগিতা থেকে তাদের বিরত রাখা যায়নি, যা নিয়ে প্রচুর সমালোচনা আসতে থাকে। একটা পর্যায়ে সিনিয়রদের সঙ্গে আলোচনা করে ২০২১ সালের শেষ দিকে ‘বাসেস অ্যান্ড কোচেস’ গ্রুপটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন তারা। বর্তমানে সেটি বন্ধ আছে।


বর্তমানে ‘বাস লাভার’ নামে আরও একটি ফেসবুক গ্রুপ আছে, যেটি সবচেয়ে বড়। ওই গ্রুপের এক মডারেটরের সঙ্গেও কথা হয় সময় সংবাদের। তারাও বিষয়টি নিয়ে বেশ বিব্রত বলে জানান। কিন্তু নেতিবাচক কিছু কাজের জন্য ইতিবাচকতা হেরে যাবে বলে মনে করেন না তিনি। তাই বন্ধ নয়, মানসিকতার পরিবর্তনের মাধ্যমে আবার ইতিবাচকতা ফিরবে বলেই বিশ্বাস তার।


আর সমাজবিজ্ঞানী ড. নেহাল করিম বলছেন, ‘এটা বিকৃত মস্তিষ্কের কাজ, যা ভবিষ্যতের জন্য উদ্বেগজনক। তিনি বলেন, এটা একটা আলাদা সুপ্তি, আনন্দ পায়। কিন্তু তাদের মস্তিষ্কের বিকৃতি বলেই আমি মনে করি। তাদের তেমন কোনো কাজ নেই, তাই তারা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে এমন কাজ করে আর আকাশ সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এমন থ্রিলিং কাজে নিজেদের নিয়োজিত করে।’

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

আরও খবর

Video