নিজস্ব প্রতিবেদক | টুয়েন্টিফোর টিভি প্রকাশিত : শুক্রবার, ২০২১ এপ্রিল ০২, ১১:৩৭ পূর্বাহ্ন
#
আন্তজার্তিক ইসলামিক ইউনিভার্সিটি চট্টগ্রাম এ চলছে নিয়োগ – পাল্টা নিয়োগ। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে করছেন শোকজ, বহিষ্কার। ১২ সদস্যের পুরানো ট্রাস্টি বোর্ড এড়িয়ে গঠন করা হয়েছে ২১ জনের নতুন ট্রাস্টি। দু’পক্ষের আছে আলাদা ভাইস চ্যান্সেলর। নিজেদের এসব কর্মকাণ্ডের নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হচ্ছে স্থানীয় গণমাধ্যমে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক পক্ষ আরেক পক্ষকে করছেন বিষোদগার। গত এক মাস যাবত আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামে ( আইআইইউসি) চলছে অনেকটা হ – য – ব – র – ল অবস্থা। আর এই কর্মকান্ডে নিজেদের শিক্ষাজীবন নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন প্রতিষ্ঠানটির দেশ- বিদেশি ১২ হাজার শিক্ষার্থী।
চট্টগ্রাম শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে সীতাকুুন্ড উপজেলার কুমিরায় অবস্থিত স্বনামধন্য এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আসল’ মালিক দাবিদার দু’পক্ষের মধ্যে দখল- পাল্টা দখলের মহড়া চলছে।
এদের একদিকে আছেন দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাতকানিয়া – লোহাগাড়া আসনের সাবেক এমপি ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নেতা আ. ন. শামসুল ইসলাম৷ আরেক পক্ষে আছেন একই আসনের আওয়ামী লীগ সমর্থিত বর্তমান এমপি ও জামায়াতের চট্টগ্রাম মহানগরীর সাবেক আমীর প্রয়াত মাওলানা মুমিনুল হক চৌধুরীর জামাতা ড. আবু রেজা নদভী। প্রথম পক্ষের অভিযোগ, এমপি নদভী প্রশাসনকে ভুল বুঝিয়ে চর দখলের মতো বিশ্ববিদ্যালয়টি দখল করতে চাইছেন। দ্বিতীয় পক্ষের বক্তব্য , যে কোন ভাবেই মৌলবাদী শক্তির কাছ থেকে প্রতিষ্ঠানটিকে রক্ষা করতে হবে।
জানা যায়, বিবাদমান দুই পক্ষের এক পক্ষের নেতৃত্ব দেয়া আবু রেজা নদভী এমপি একসময় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। নিজের ভাষাগত দক্ষতা থাকা ও মেধাবী হওয়ার সুবাদে সেসময় প্রতিষ্ঠানটির বিদেশ বিষয়ক সমন্বয়কের দায়িত্ব পান তিনি। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিষ্ঠানটির জন্য অনুদান নিয়ে এসেছিলেন নদভী। তৎকালীন নগর জামায়াতের আমীর মুমিনুল হক চৌধুরীর জামাতা ও দলটির প্রধান গোলাম আজমের সাথে ঘনিষ্ঠতার কারণেও প্রতিষ্ঠানটিতে সেসময় তার ছিলো বিশেষ কদর।
তবে আ ন ম শামসুল ইসলাম নগর জামায়াতের আমীর ও প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নিযুক্ত হওয়ার পর দিন দিন কোণঠাসা হয়ে পড়েন আবু রেজা নদভী।একপর্যায়ে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক ও সিন্ডিকেট থেকে বাদ পড়েন মুমিনুল হক চৌধুরীর এই জামাতা। পরে তিনি নিজের প্রতিষ্ঠিত আল্লামা ফয়জুল্ললাহ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হন।একপর্যায়ে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে এমপি হওয়ার পর নিজের সবকিছু পাল্টে ফেলেন তিনি ।
জানা যায়, এমপি হওয়ার পর আবারো আই আই ইউসিতে ক্ষমতাশীল হয়ে উঠেন আবু রেজা নদভী। অভিযোগ আছে,২০১৫ সালে অনেকটা জোর করেই তিনি প্রতিষ্ঠানটির অধ্যাপক পদ লাভ করেন। নিজের সেখানে কোন পদ না থাকলেও প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন বিষয়ে প্রভাব বিস্তার করতে থাকেন এই সাংসদ। সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারি মাসের ২৮ তারিখ করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও বর্তমান ১২ সদস্যের ট্রাস্টি বোর্ড ডিঙ্গিয়ে ২১ সদস্যের ট্রাস্টি গঠন করেন তিনি। এর একদিন পর ১ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয় নবগঠিত এই বোর্ডের অনুমোদন দেন বলে সংবাদ পত্রে পাঠানো বিজ্ঞাপ্তিতে বলা হয়। যদিও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ অনুসারে, কেবলমাত্র পুরাতন ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরাই নতুন ট্রাস্টি সদস্য নিতে পারবেন। আর ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের ভোটেই এর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে থাকেন। সেদিক থেকে এতোদিনের ট্রস্টি সদস্যদের বাদ দিয়ে নিজের মতো করে ট্রাস্টি বোর্ড গঠন ও স্বঘোষিত ট্রাস্টি চেয়ারম্যান হওয়া কোনভাবেই বিধিসম্মত নয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা যায়, এমপি ড. আবু রেজা নদভী নিজের গঠিত ট্রাস্টি বোর্ডের প্রথম সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রো-ভিসি, রেজিস্টারসহ পাঁচজনকে শোকজ করার সিদ্ধান্ত নেন। যদিও এই ঘটনার ২ দিন আগে এমপি নদভী নিজ বাসায় ডেকে রেজিস্টার কর্ণেল ( অব:) মোঃ কাশেম পিএসসিকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলেন।
একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব বিভাগের পরিচালক তৌফিকুর রহমানকেও বাসায় ডেকে নিয়ে এক পর্যায়ে নাজেহাল করেন বলে জানান নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র।
এদিকে বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেকটা অসহায় হয়ে কয়েকদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. গোলাম মহিউদ্দিন পদিত্যাগ করেন।একারণে ২৭ তারিখ আ ন ম শামসুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপ – উপাচার্য ড. আলী আজাদীকে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। এর মাত্র ১দিন পর মঙ্গলবার ( ২৮ মার্চ) বিকেলে এমপি নদভী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও সোস্যাল ইসলামি ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক আনোয়ারুল আজীম আরিফকে প্রতিষ্ঠানটির উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেন। যদিও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী, সরকারির মতো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও উপাচার্যের নিয়োগ ক্ষমতা একমাত্র রাষ্ট্রপতির হাতেই থাকে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কোন ব্যক্তির জন্য সুপারিশ করতে পারেন মাত্র। এছাড়া নিয়ম অনুযায়ী উপাচার্যের অবর্তমানে বর্তমান উপ – উপাচার্য ড. আজাদীই ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হওয়ার কথা।
জানা যায়,নিয়োগ প্রাপ্ত অধ্যাপক আনোয়ারুল আজিমের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য থাকাকালীন নানা অনিয়নের অভিযোগ ছিলো।এরমধ্যেই কোন নিয়ম ব্যাতিত বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক শত শিক্ষক -কর্মকর্তা নিয়োগ, নিজের পরিবারের সদস্যদের শিক্ষক বানাতে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজকে ইন্সটিটিউট করে ফ্যাকাল্টির মান দেয়াসহ নানা অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে । সেসময় তার বিরুদ্ধে মৌলবাদী জামায়াতকে তোষণসহ নানা অভিযোগ করেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শিক্ষকরা।
এদিকে আইআইইউসির চলমান সংকট নিয়ে এমপি আবু রেজা নদভী বলেন, মাওলানা শামসুল ইসলামরা বিশ্ববিদ্যালয়কে জামায়াতিকরণ করে ফেলছেন। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটি কোটি টাকা লোপাট করেছেন।এরকারণে নতুন করে ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। শীগ্রই শ্বেতপত্র আকারে তাদের এসব অনিয়ম তুলে ধরা হবে।
তবে বর্তমান উপাচার্যের অবর্তমানে উপ- উপাচার্যই দায়িত্ব পালনের রীতি হলেও কোন পদ্ধতিতে আনোয়ারুল আজিমকে উপাচার্য নিয়োগ দেয়া হয়েছে জানতে চাইলে ড. আবু রেজা বলেন, ‘ আজাদী সাহেব মামলার আসামী। উনি কিভাবে ভিসি হবেন।আর উনাকে তো পাওয়াই যাচ্ছে না। আর উনি পদত্যাগ করতে চাইলেও শামসুল ইসলাম সাহেবের চাপে করতে পারছেন না।’
এদিকে এমপি নদভীর অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে এতোদিন ট্রাস্টি চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বপালন করা মাওলানা শামসুল ইসলাম এই প্রতিবেদককে বলেন, ট্রাস্ট আইন ১৮৮২, সোসাইটিজ রেজি: আইন-১৮৬০, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯৯২, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ এর বিধিবিধান পুরোপুরি মেনেই আইআইইউসির কার্যক্রম চলে আসছে।শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মস সময়ে অসময়ে এ বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টি বোর্ডের সার্বিক কার্যক্রমে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। কেউ চাইলে তো পৈত্রিক সম্পত্তির মতো নতুন ট্রাস্ট গঠন বা পুরাতন ট্রাস্ট ভেঙ্গে দিতে পারেন না।
আইআইইউসিকে জামায়াতিকরণ নিয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় জামায়াতের এই নেতা বলেন,’ আচ্ছা আমি যদি জামায়াত হই, তাহলে উনি কি। মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী আবু রেজা এমপি প্রতিষ্ঠিত আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ।
জামায়াতের সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আজম প্রদত্ত প্রত্যয়নপত্র নিয়ে বিভিন্ন বিদেশী সংস্থা ও ব্যক্তির কাছ থেকে আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশনের জন্য অর্থ কালেকশন করেছেন। আসল কথা হচ্ছে জামায়াত জুজুর ভয় দেখিয়ে নদভী সাহেবরা স্বনামধন্য এই প্রতিষ্টানকে কুক্ষিগত করতে চাইছেন।’
উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামে ( আইআইইউসি) জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বনামধন্য একটি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে সুপরিচিতি। ৪৩ একর জমির উপর নিজস্ব ক্যাম্পাসে ৪০ টি ভবন নিয়ে গড়ে উঠা এই প্রতিষ্ঠান আয়তনে বাংলাদেশের বৃহত্তম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।
ওয়েবমেট্রিক র্যাংকিং অনুযায়ী বাংলাদেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর মধ্যে ২৫ তম স্থানে এবং ইউজিসির তালিকা অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে শীর্ষ ৯ এর অন্যতম ও চট্টগ্রামে ১ম স্থানে অবস্থান করছে এই প্রতিষ্ঠান ।
সূত্র: চট্টলানিউজ২৪
মন্তব্য করুন