শুক্রবার, ২০২৫ মে ০২, ১৯ বৈশাখ ১৪৩২
#
আন্তর্জাতিক আন্তর্জাতিক

যে কারণে ইমরান খানের পতন

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | টুয়েন্টিফোর টিভি
প্রকাশিত : রবিবার, ২০২২ এপ্রিল ১০, ০২:৪০ অপরাহ্ন
#

পদত্যাগ অথবা ক্ষমতাচ্যুতি, সামনে ছিল এই দুটি বিকল্পই। তবে নানা রাজনৈতিক নাটক আর সাংবিধানিক বিশৃঙ্খলার পর অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে অবশেষে ক্ষমতাচ্যুতির মধ্যদিয়েই শেষ হয়েছে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরান খানের টালমাটাল মেয়াদ। এ ঘটনার পর ঠিক কোন কারণে ইমরানের পতন হয়েছে, তা নিয়েও চলছে নানা গুঞ্জন।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, পাকিস্তানের সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক পতন নিহিত ছিল নতুন দুই বাস্তবতার মধ্যে। প্রথমত, পার্লামেন্টে জোট মিত্রদের সমর্থন হারিয়েছিল ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)। ফলে অনাস্থা ভোটে জয় পেতে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছেন ইমরান।  

দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানের শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর সমর্থন হারানোর কারণেই ইমরান খানের পতন হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। ২০১৮ সালে সেনাবাহিনীর সহায়তা নিয়েই তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন বলে জানা যায়। তবে এ অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে পিটিআই ও সামরিক বাহিনী।  

ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে নিজেদের প্রচেষ্টা বাড়ায় পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি), পাকিস্তান মুসলিম লীগসহ (পিএমএলএন) দেশটির প্রধান বিরোধী দলগুলো। একই সময়ে ইমরানের বিরুদ্ধে নিজেদের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতে শুরু করে তার জোট মিত্ররাও। 

গত মার্চের শেষের দিকে ইমরান খানের পক্ষে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয় তার জোট মিত্র বেলুচিস্তান আওয়ামী পার্টি (বিএপি)। আনোয়ার উল হক কাকার নামে দলটির একজন শীর্ষ নেতা সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে বলেন, শাসন​ব্যবস্থায় সরকার সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। গত দুই বছর ধরে অশান্তি চলছিল। 

ইমরান খানের পূর্ববর্তী মিত্রদের মধ্যে নোংরা রাজনীতির খেলা আরও স্পষ্ট হয় যখন তার বিশেষ সহকারী নাদিম আফজাল পদত্যাগ করেন এবং গত মার্চের শুরুতে বিরোধী দল পিপিপিতে যোগ দেন। আফজালের মতে, ইমরানের দুর্নীতিবিরোধী প্ল্যাটফর্ম দেখেই মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পরে তার স্থিতাবস্থায় হতাশ হয়ে পড়েন আফজাল। তিনি বলেন, ‘প্রকাশ্যে গরিবদের কথা বললেও, ব্যক্তিগতভাবে ধনী বিনিয়োগকারীদের মধ্যেই থাকতেন ইমরান খান।’  

অর্থনৈতিক মন্দা 

ইমরান খানের প্রতি সৃষ্ট অসন্তোষের অন্যতম বড় কারণ ছিল পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকট। এ ছাড়া দেশটির দুই অঙ্কের মুদ্রাস্ফীতিও তার সামনে বড় বাধা ছিল।  

বিরোধীরা ইমরানের খানের বিরুদ্ধে হাত মেলানোর পর, বিশ্বব্যাপী বৃদ্ধি সত্ত্বেও গত ফেব্রুয়ারিতে দেশীয় জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম কমানোর ঘোষণা দেন পাকিস্তানের সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী। জুনে অর্থবছরের শেষ পর্যন্ত এই দামই বহাল রাখার প্রতিশ্রুতিও দেন তিনি। 

কিন্তু ইমরান খানের এই পদক্ষেপ পাকিস্তানের দীর্ঘস্থায়ী রাজস্ব ঘাটতি এবং অর্থপ্রদানের ভারসাম্য সংক্রান্ত সমস্যাগুলোর ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করে। মার্কিন ডলারের বিপরীতে রেকর্ড হারে কমে যায় পাকিস্তানি রুপির দর। ফলে জরুরি বৈঠকে বসে সুদের হার দ্রুত বৃদ্ধি করতে বাধ্য হয় স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান।  

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্লাভাটনিক স্কুল অব গভর্নমেন্টের অর্থনীতিবিদ শাহরুখ ওয়ানির মতে, পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সংকটের একটি অংশ ছিল পূর্ববর্তী সরকারের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া পরিস্থিতি এবং বাকি অংশ অবশ্যই করোনাসৃষ্ট। এর ফলে পাকিস্তান সরকার দ্রুতই গভীর সংকটে পড়ে যায় এবং সংকট সমাধানের কার্যকর কোনো পদক্ষেপও নেওয়া হয়নি।  

ইমরান খানের বিশেষ সহকারী নাদিম আফজাল বলেন, মুদ্রাস্ফীতি, সারের ঘাটতি, পাঞ্জাবের স্থানীয় সরকার নিয়ে টানাপড়েন, আধিপত্য এসব কিছু অতিরিক্ত পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। ফলে পার্লামেন্টে মিত্রদের সমর্থন হারিয়ে চাপে পড়েন ইমরান। 

৩৪২ সদস্যের জাতীয় পরিষদে বিএপি, মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট (এমকিউএম) এবং পাকিস্তান মুসলিম লীগ–কায়েদের (পিএমএল-কিউ) পাঁচ শতাংশেরও কম আসন রয়েছে। কিন্তু ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোটকে সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জোটের মিত্ররা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খানের সাড়ে তিন বছরের মেয়াদ কার্যকরভাবেই শেষ করে দিতে সক্ষম হয়েছে। এ ছাড়া ভিন্নমতাবলম্বী পিটিআইয়েরবেশ কয়েকজন সংসদ সদস্যের সমর্থন পাওয়ার দাবিও করেছে বিরোধী দলগুলো। 

এদিকে স্থবির অবস্থায় রয়েছে পাকিস্তানের অর্থনীতি। দেশটির সাবেক অর্থমন্ত্রী মিফতাহ ইসমাইল জানান, এই মুহূর্তে পাকিস্তানের সামনে সবচেয়ে বড় দুটি অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ হল উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি এবং দ্রুত কমে যাওয়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। 

তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো রিজার্ভ কমে যাওয়ায় মুদ্রার অবমূল্যায়ন হচ্ছে, যা আরও বেশি মূল্যস্ফীতির জন্ম দিয়েছে।’  

সামরিক বাহিনীর ভূমিকা 

ইমরান খানের প্রস্থান নিশ্চিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমবর্ধমানভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠছে পাকিস্তানের রাজনীতির অন্য এক সংকট। তা হলো বেসামরিক-সামরিক সম্পর্ক। 

এই সংকট আগেই শুরু হয় যখন সামরিক বাহিনী ইঙ্গিত দেয় যে তারা ‘নিরপেক্ষতার নীতি’ অনুসরণ করে বিরোধীদের আনা অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে ইমরান খানের পাশে থাকবে না। দেশটির সেনাবাহিনীর এমন অবস্থানের পর ইমরানের ক্ষমতাচ্যুতি ছিল কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র। 

গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ এবং পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ানো পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রীদের দীর্ঘ তালিকায় সবশেষ ছিলেন ইমরান খান।   

গত বছরের অক্টোবরে সেনাপ্রধান জেনারেল কামার বাজওয়ার মনোনীত প্রার্থীকে প্রত্যাখ্যান করে ইমরান খান যখন লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফয়েজ হামিদকে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা-আইএসআইয়ের প্রধান হিসেবে বহাল রাখার চেষ্টা করেন তখনই মূলত দেশটিতে বেসামরিক-সামরিক উত্তেজনার চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে।  

কিন্তু শেষ পর্যন্ত আইএসআইয়ের নতুন মহাপরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হন জেনারেল বাজওয়ার মনোনীত প্রার্থী লেফটেন্যান্ট জেনারেল নাদিম আঞ্জুম। তবে এর মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে ইমরানের দূরত্ব ছিল চোখে পড়ার মতোই।  

সেনাপ্রধান হিসেবে জেনারেল বাজওয়ার দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হবে আগামী নভেম্বরে। এরপর তার স্থলাভিষিক্ত পারেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফয়েজ হামিদ। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী সেনাপ্রধান নিয়োগ করে থাকেন।  

পাকিস্তানের বৃহত্তম বাণিজ্যিক এবং সামরিক বাহিনীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টায় কমতি ছিল না ইমরান খানের। কিন্তু ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের আগে তার মস্কো সফর পাল্টে দেয় পরিস্থিতি।  

পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী খানের মস্কো সফরকে সমর্থন করলেও এ নিয়ে তীব্র মতপার্থক্য দেখা দেয়। পরে পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে পরাজয়ের সম্মুখীন হয়ে, ইমরান তার রাশিয়া সফর এবং নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতির শাস্তি হিসেবে তাকে অপসারণের জন্য মার্কিন চক্রান্তের অভিযোগ করেন। 

চক্রান্তের প্রমাণ হিসেবে গত ২৭ মার্চ ইসলামাবাদের এক জনসভায় সবার সামনে একটি চিঠি তুলে ধরে ইমরান দাবি করেছিলেন যে যুক্তরাষ্ট্র তাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারণের জন্য পাকিস্তানকে কূটনৈতিক সতর্কবার্তা দিয়েছে। 

কূটনৈতিক বার্তা, কথিত মার্কিন হুমকি এবং দেশের বিরোধীদের সঙ্গে মিলে যুক্তরাষ্ট্রের ষড়যন্ত্রের এসব অভিযোগ পরবর্তীতে পাকিস্তানের রাজনীতি এবং বেসামরিক-সামরিক সম্পর্ককে বিপর্যস্ত করে তোলে। 

অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা এয়ার ভাইস মার্শাল শাহজাদ চৌধুরীর মতে, ইমরান খান নীতিগত বিষয়ে পারদর্শী হতে পারলেও তার মধ্যে দূরদর্শিতা বা স্থিতিশীলতা ছিল না। ইমরান খান একজন পপুলিস্ট, এটাই তার দুর্বলতা।’  

যদিও সংসদের ভেতরে ও বাইরে পরাজিত হলেও রাজনীতি থেকে ইমরান খানের ছিটকে পড়ার সম্ভাবনা কম। এর বড় কারণ তার প্রতি থাকা বড় জনসমর্থন। এ ছাড়া পাকিস্তানের রাজনীতির চক্রাকার ইতিহাস এর আগেও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অনেক নেতার প্রত্যাবর্তন দেখেছে। উর্বর রাজনৈতিক ভিত্তি থেকে ফের ক্ষমতায় ফিরে আসার সুযোগও ইমরান খানের সামনে রয়েছে।  

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, মুদ্রাস্ফীতি এবং নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির জন্য এক মাস আগেও যারা পিটিআই সরকারকে গালি দিচ্ছিল; তারাই এখন ‘গর্বিত এবং স্বাধীন পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়ানো’ ইমরান খানকে সমর্থন দিচ্ছেন।

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

আরও খবর

Video