বৃহস্পতিবার, ২০২৫ মে ০১, ১৮ বৈশাখ ১৪৩২
#
জাতীয় জাতীয়

কফিনবন্দি হয়ে দেশে ফিরলেন গাফ্ফার চৌধুরী

নিজস্ব প্রতিবেদক | টুয়েন্টিফোর টিভি
প্রকাশিত : শনিবার, ২০২২ মে ২৮, ১১:৪০ পূর্বাহ্ন
#

বর্ষীয়ান সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও লেখক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মরদেহ ঢাকায় পৌঁছেছে। শনিবার (২৮ মে) বেলা ১১টার দিকে মরদেহবাহী বিমানটি হযরত শাহজালাল (রাহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আগেই জানানো হয়, সরকারের পক্ষ থেকে মরদেহ গ্রহণ করবেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।

বিমানবন্দর থেকে মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেওয়া হবে। গার্ড অব অনার এবং সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য দুপুর ১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত মরদেহ সেখানে রাখা হবে। এরপর সাড়ে ৩টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে জানাজা হবে।

আরও পড়ুন:  একনজরে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী


বিকেল ৪টায় মরদেহ নেওয়া হবে জাতীয় প্রেস ক্লাবে। শ্রদ্ধা নিবেদনের পর মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে মরদেহ নেওয়া হবে। গাফ্ফার চৌধুরীর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী সেখানে স্ত্রীর কবরের পাশে বিকেল সাড়ে ৫টায় তাকে সমাহিত করা হবে।

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী গত ১৯ মে লন্ডনের একটি হাসপাতালে মারা যান। ২০ মে তার প্রথম জানাজা ইংল্যান্ডের ব্রিকলেন মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া সেখানকার আলতাব আলী পার্কের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষ তার প্রতি শ্রদ্ধা জানান।

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানের রচয়িতা আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী তার মেধা-কর্ম ও লেখনীতে এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রেখেছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ সরকার নিবন্ধিত সাপ্তাহিক ‘জয় বাংলা’ পত্রিকায় বিভিন্ন লেখালিখির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছেন। পরবর্তী সময়ে তিনি প্রবাসে থেকেও তার লেখনীর মাধ্যমে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের কাছে তুলে ধরেছেন।

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী ১৯৩৪ সালের ১২ ডিসেম্বর বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জের উলানিয়ার চৌধুরীবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা হাজি ওয়াহিদ রেজা চৌধুরী ও মা জহুরা খাতুন। ১৯৫০ সালে গাফ্‌ফার চৌধুরী পরিপূর্ণভাবে কর্মজীবন শুরু করেন।
তিনি ‘দৈনিক ইনসাফ’ পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। মহিউদ্দিন আহমদ ও কাজী আফসার উদ্দিন আহমদ তখন ‍‘দৈনিক ইনসাফ’ পরিচালনা করতেন। ১৯৫১ সালে ‘দৈনিক সংবাদ’ প্রকাশ হলে গাফ্‌ফার চৌধুরী সেখানে অনুবাদকের কাজ নেন। এরপর তিনি বহু পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন। ভাষা আন্দোলনের স্মরণীয় গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’র রচয়িতা তিনি।

শিক্ষাজীবন

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী উলানিয়া জুনিয়র মাদরাসায় ক্লাস সিক্স পর্যন্ত লেখাপড়া করে হাইস্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। ১৯৫৩ সালে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৮ সালে বিএ অনার্স পাস করেন। তার বাবার মৃত্যুর পর তাকে চলে যেতে হয় বরিশাল শহরে। এরপর ভর্তি হন আসমত আলী খান ইনস্টিটিউটে। সে সময় আর্থিক অনটনের শিকার হয়ে উপার্জনের পথ খুঁজতে থাকেন। ১৯৪৭ সালে তিনি কংগ্রেস নেতা দুর্গা মোহন সেন সম্পাদিত ‘কংগ্রেস হিতৈষী’ পত্রিকায় কাজ শুরু করেন। বরিশাল শহরে তিনি কিছুদিন একটি মার্ক্সবাদী দল আরএসপির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ছাত্রজীবনেই তার সাহিত্যচর্চা শুরু। ১৯৪৯ সালে ‘সওগাত’ পত্রিকায় তার প্রথম গল্প ছাপা হয়। বরিশালের সন্তান শামসুদ্দীন আবুল কালামের লেখা তখন কলকাতার প্রধান পত্রিকাগুলোয় ছাপা হতো।

কর্মময় জীবন

১৯৫০ সালে গাফ্‌ফার চৌধুরীর কর্মজীবন পরিপূর্ণভাবে শুরু হয়। এ সময় তিনি ‘দৈনিক ইনসাফ’ পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তখন বেতন পেতেন ৭০ টাকা। মহিউদ্দিন আহমদ ও কাজী আফসার উদ্দিন আহমদ তখন ‘দৈনিক ইনসাফ’ পরিচালনা করতেন। ১৯৫১ সালে ‘দৈনিক সংবাদ’ প্রকাশ হলে গাফ্ফার চৌধুরী সেখানে অনুবাদকের কাজ নেন। জুনিয়র ট্রান্সলেটর হিসেবে মাসিক বেতন পেতেন ১০০ টাকা। এরপর তিনি বহু পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৫৩ সালে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের মাসিক ‘সওগাত’ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হন গাফ্‌ফার চৌধুরী। এ সময় তিনি মাসিক ‘নকীব’ও সম্পাদনা করেন। একই বছর তিনি আবদুল কাদির সম্পাদিত ‘দিলরুবা’ পত্রিকারও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হন।

১৯৫৬ সালে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী দৈনিক ইত্তেফাকের সহকারী সম্পাদক নিযুক্ত হন। ওই বছরই তিনি প্যারামাউন্ট প্রেসের সাহিত্য পত্রিকা ‘মেঘনা’র সম্পাদক হন। ১৯৫৮ সালে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার রাজনৈতিক পত্রিকা ‘চাবুক’-্এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পান। কিন্তু কিছুদিন পর সামরিক শাসন চালু হলে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর তিনি মওলানা আকরম খাঁ-র ‘দৈনিক আজাদ’-এ সহকারী সম্পাদক পদে যোগ দেন। এ সময় তিনি মাসিক ‘মোহাম্মদীর’ও স্বল্পকালীন সম্পাদক হয়েছিলেন। ১৯৬২ সালে তিনি দৈনিক ‘জেহাদ’-এ বার্তা সম্পাদক পদে যোগ দেন। ১৯৬৩ সালে তিনি সাপ্তাহিক ‘সোনার বাংলা’র সম্পাদক হন। পরের বছর ১৯৬৪ সালে সাংবাদিকতা ছেড়ে দিয়ে ব্যবসায় নামেন এবং ‘অনুপম মুদ্রণ’ নামে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। দু-বছর পরই আবার ফিরে আসেন সাংবাদিকতায়। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনের মুখপত্র হিসেবে ‘দৈনিক আওয়াজ’ বের করেন। সেটা বছর দুয়েক চলেছিল। ১৯৬৭ সালে আবার তিনি ‘দৈনিক আজাদ’-এ ফিরে যান সহকারী সম্পাদক হিসেবে।


এ ছাড়া ১৯৬৯ সালে পত্রিকাটির মালিকানা নিয়ে সহিংস বিবাদ শুরু হলে তিনি আবার যোগ দেন ‘দৈনিক ইত্তেফাকে’। ১৯৬৯ সালের ১ জানুয়ারি ইত্তেফাক সম্পাদক মানিক মিয়া মারা গেলে তিনি আগস্ট মাসে হামিদুল হক চৌধুরীর অবজারভার গ্রুপের দৈনিক ‘পূর্বদেশ’-এ যোগ দেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সপরিবারে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলা হয়ে কলকাতা পৌঁছান। সেখানে মুজিবনগর সরকারের মুখপত্র সাপ্তাহিক ‘জয় বাংলা‘য় লেখালিখি করেন। এ সময় তিনি কলকাতায় ‘দৈনিক আনন্দবাজার’ ও ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় কলামিস্ট হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ‘দৈনিক জনপদ’ বের করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলজিয়ার্সে ৭২ জাতি জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে যান। দেশে ফেরার পর তার স্ত্রী গুরুতর রোগে আক্রান্ত হলে তাকে চিকিৎসার জন্য প্রথমে কলকাতা নিয়ে যান। সেখানে সুস্থ না হওয়ায় তাকে নিয়ে ১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাসে লন্ডনের উদ্দেশে পাড়ি জমান। এরপর তার প্রবাসজীবনের ইতিহাস শুরু হয়। বিদেশ যাওয়ার পর প্রথম দিকে তিনি বিভিন্ন গ্রোসারি দোকানে কাজ করেন। এরপর ১৯৭৬ সালে তিনি ‘বাংলার ডাক’ নামে এক সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদনা করেন। ‘সাপ্তাহিক জাগরণ’ পত্রিকায়ও তিনি কিছুদিন কাজ করেছেন। ১৯৮৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি সাতজন অংশীদার নিয়ে ‘নতুন দিন’ পত্রিকা বের করেন।

এরপর ১৯৯০ সালে ‘নতুন দেশ’ এবং ১৯৯১ সালে ‘পূর্বদেশ’ বের করেন। প্রবাসে বসে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত গাফ্ফার চৌধুরী বাংলাদেশের প্রধান পত্রিকাগুলোতে নিয়মিত লিখেছেন। বাংলাদেশের শীর্ষ দৈনিকগুলোতে প্রকাশিত আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর রাজনীতি, সমসাময়িক ঘটনা ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি নিয়ে লেখা কলাম অত্যন্ত জনপ্রিয়। বাংলাদেশে তিনি আওয়ামী লীগপন্থি কলামিস্ট হিসেবে পরিচিত এবং সমালোচিত। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ প্রচারক হিসেবে তিনি রাজনৈতিক বিষয়াবলি ব্যাখ্যা করে থাকেন।
 
তার গ্রন্থসমূহ

চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান (১৯৬০), নাম না জানা ভোর (১৯৬২), নীল যমুনা (১৯৬৪), শেষ রজনীর চাঁদ (১৯৬৭), কৃষ্ণপক্ষ (১৯৫৯), সম্রাটের ছবি (১৯৫৯), সুন্দর হে সুন্দর (১৯৬০), ডানপিটে শওকত (১৯৫৩)।

সম্পাদনা

বাংলাদেশ কথা কয় (১৯৭২), পলাশী থেকে ধানমণ্ডি (২০০৭), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনীভিত্তিক একটি চলচ্চিত্রের কাহিনী, আমরা বাংলাদেশি নাকি বাঙালি।

সাংবাদিকতার পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস, স্মৃতিকথা, ছোটদের উপন্যাসও লিখেছেন তিনি। ‘চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান’, ‘সম্রাটের ছবি’, ‘ধীরে বহে বুড়িগঙ্গা’, ‘বাঙালি না বাংলাদেশী’সহ তার প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা প্রায় ৩০। এ ছাড়া তিনি কয়েকটি পূর্ণাঙ্গ নাটক লিখেছেন। এর মধ্যে আছে ‘পলাশী থেকে বাংলাদেশ’, ‘একজন তাহমিনা’ ও ‘রক্তাক্ত আগস্ট’।

পুরস্কার ও সম্মাননা

ইউনেসকো পুরস্কার ( ১৯৬৩), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৭), একুশে পদক, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, সংহতি আজীবন সম্মাননা পদক ২০০৮, লন্ডন, স্বাধীনতা পদক ২০০৯, মানিক মিয়া পদক ২০০৯, যুক্তরাজ্যের ফ্রিডম অব বারা (টাওয়ার হ্যামলেটস) উপাধি, সংহতি আয়োজিত প্রবাসীদের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা, ঢাকা ২০০৯।

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

আরও খবর

Video