মঙ্গলবার, ২০২৫ এপ্রিল ২৯, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২
#
জেলা-উপজেলা জেলা-উপজেলা

‘আমি ঢাকায় না দিলে আমার মেয়ে মারা যেত না’

নিজস্ব প্রতিবেদক | টুয়েন্টিফোর টিভি
প্রকাশিত : সোমবার, ২০২৩ জানুয়ারী ২৩, ০৯:৪৪ পূর্বাহ্ন
#

উচ্চশিক্ষিত হতে এক সপ্তাহ আগে ঢাকায় আসেন নাদিয়া আক্তার (১৯)। ভর্তি হয়েছিলেন নর্দান ইউনিভার্সিটির ফার্মেসি বিভাগে। বাবা, মা ও নিজের উচ্চশিক্ষার সেই স্বপ্নের যাত্রা সড়কেই থামিয়ে দিয়েছে বাস। পোশাক কারখানার কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর মৃধা তাঁর মেয়ের মরদেহ নিয়ে রাতে তাঁর গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালী চলে যান। যাওয়ার আগে তিনি বলে গেলেন, ‘আমি ঢাকায় না দিলে আমার মেয়ে মারা যেত না।’

প্রগতি সরণির যমুনা ফিউচার পার্কের সামনের সড়কে রোববার দুপুরে পিষ্ট হয় নাদিয়া আক্তার। তাঁকে পিষ্ট করা ভিক্টর ক্ল্যাসিক পরিবহনের বাসটি আটক করলেও চালক ও তাঁর সহকারী পালিয়ে গেছেন।

নাদিয়া নিহত হওয়ার প্রতিবাদে বিকেলে কাওলা এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক প্রায় এক ঘণ্টা অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দায়ী বাসচালককে অবিলম্বে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।

আশকোনার নর্দান ইউনিভার্সিটির ৪২তম ব্যাচের ফার্মাসি বিভাগের ছাত্রী নাদিয়াদের বাসা নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার তল্লা এলাকায়। উচ্চশিক্ষিত হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ভর্তি হন বিশ্ববিদ্যালয়ে। যাতায়াতে কষ্টের কারণে এক সপ্তাহ আগে উত্তরার একটি ছাত্রী হোস্টেলে উঠেছিলেন। রাতে লাশ নিয়ে গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালী রওনা দেওয়ার আগে তাঁর বাবা জাহাঙ্গীর মৃধা বলেন, ‘আমার সব স্বপ্ন শেষ।’

প্রত্যক্ষদর্শী সারোয়ার বলেন, বেলা একটার দিকে ভিক্টর ক্ল্যাসিক নামের বাসটি যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে একটি মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দেয়। এতে মোটরসাইকেলের পেছনে বসা মেয়েটি ছিটকে রাস্তায় পড়ে যান। চলতে থাকা বাসটির পেছনের চাকায় পিষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়। এরপর পুলিশ আসে। পুলিশ বাসটি আটক করলেও চালক ও সহকারী পালিয়ে গেছেন। আরেকজন জানান, মোটরসাইকেলচালক সড়কের বাঁ দিকে পড়ায় তাঁর কিছু হয়নি।

জানা গেছে, বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস বন্ধ থাকায় নাদিয়া একই বিভাগের ৪১তম ব্যাচের ছাত্র মেহেদী হাসানের সঙ্গে যমুনা ফিউচার পার্কে ঘুরতে যাচ্ছিলেন। নাদিয়ার বাবা জাহাঙ্গীর মৃধা একটি পোশাক কারখানার সহকারী মহাব্যবস্থাপক। মা পারভিন বেগম গৃহিণী। ছোট দুই বোন সামিয়া ও মারিয়া। তারা নারায়ণগঞ্জে স্কুলে লেখাপড়া করে।

পুলিশ লাশ উদ্ধার করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের মর্গে পাঠায়। সেখানে ময়নাতদন্ত হয়। সন্ধ্যায় জাহাঙ্গীর মৃধা ও পারভিন বেগম সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের সামনে বসে বিলাপ করছিলেন। স্বজনদের সান্ত্বনা থামাতে পারেনি সন্তান হারানোর কান্না।

জাহাঙ্গীর মৃধা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘২০২২ সালে নারায়ণগঞ্জ মহিলা কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে নাদিয়া। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নর্দান ইউনিভার্সিটিতে মেয়েকে ভর্তি করাই। নারায়ণগঞ্জ থেকে এসে ক্লাস করা কষ্টের, তাই উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টরের একটি ছাত্রী হোস্টেলে তুলে দিই। এক সপ্তাহ আগে উত্তরা আসে। আমি ঢাকায় না দিলে আমার মেয়ে মারা যেত না।’

নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ে নাদিয়ার সহপাঠী আব্দুর রহমান তৌফিক বলেন, ‘১২ জানুয়ারি ওরিয়েন্টেশন ক্লাস হয়। এরপর ক্লাস হয়নি। বিশ্ব ইজতেমার কারণে ক্লাস স্থগিত। এ সপ্তাহ থেকে ক্লাস হওয়ার কথা। এর মধ্যেই এই ঘটনা ঘটল।’

নর্দান ইউনিভার্সিটির ফার্মাসি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. হারুন অর রশীদ বলেন, ‘সড়কে কারও নিরাপত্তা নেই। একটা মেয়ে অনেক স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় এল, লাশ হয়ে বাড়ি ফিরে গেল।’ 

ভাটারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ বি এম আছাদুজ্জামান বলেন, ঘটনাস্থলেই নাদিয়ার মৃত্যু হয়। বাসটিকে আটক করলেও চালক ও হেলপার পালিয়েছেন। তাঁদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। নাদিয়ার বাবা এ ঘটনায় মামলা করেছেন। তিনি বলেন, নাদিয়ার বন্ধু মেহেদী ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁকে মামলার সাক্ষী করা হয়েছে।

এদিকে বাসচাপায় নাদিয়া নিহত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিকেল পাঁচটার দিকে কাওলায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের উভয় পাশ অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী এতে অংশ নেন। এতে মহাসড়কের দুই পাশে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে পুলিশের অনুরোধে তাঁরা মহাসড়ক থেকে সরে যান।

শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘আমরা সহপাঠী হত্যার বিচারের দাবিতে মহাসড়ক অবরোধ করেছি। প্রতিনিয়ত সড়কে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হচ্ছে। এর আগেও শিক্ষার্থীরা সড়কে নেমে আন্দোলন করেছে। কিন্তু সড়কে মৃত্যু কমেনি।’ দায়ী বাসচালককে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়ে তাঁরা বলেন, দাবি আদায় না হলে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।

ট্রাফিক পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) নাবিদ কামাল শৈবাল বলেন, বিশ্ব ইজতেমার কারণে মহাসড়কে যানজট ছিল। বিকেলে যখন যানজট স্বাভাবিক করা হয়েছে, ঠিক তখন শিক্ষার্থীরা মহাসড়ক অবরোধ করেন। ফলে আবার যানজটের সৃষ্টি হয়। তবে অনুরোধ করার পর তাঁরা চলে যান।

এর আগে ২০১৯ সালের ১৯ মার্চ যমুনা ফিউচার পার্কের কাছে বাসচাপায় নিহত হন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের ছাত্র আবরার আহমেদ চৌধুরী। একই বছর সেপ্টেম্বরে ভিক্টর ক্ল্যাসিক বাসের চাপায় তুরাগ এলাকায় কণ্ঠশিল্পী ও সংগীত পরিচালক পারভেজ রব নিহত হন। এর কয়েক দিন পর ভিক্টর ক্ল্যাসিকের আরেকটি বাসের চাপায় নিহত হন তাঁর ছেলের বন্ধু মেহেদী এবং আহত হন তাঁর ছেলে আলভি।

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

আরও খবর

Video